পড়ুন আগের সংখ্যাগুলি

Saturday, December 15, 2018

কুন্তল মুখোপাধ্যায়- করুণকুমারের গল্প





পৃথিবীতে সত্যি কোনও রূপকথা নেই , অথচ গল্পে আছে । অনেকে বলেছেন বাচ্চাদের রূপকথা শোনানো অথবা পড়ানো উচিত নয় । অথচ আমাদের ছেলেবেলা রুপকথাচিহ্নিত হয়ে আছে । কী হয় রূপকথা পড়ে ? সেখানে যেসব চরিত্র আছে তারা কি এই পৃথিবীর কেউ নয় ?  সেসব কাহিনী পড়লে কি অবাস্তব বোধসম্পন্ন হয়ে যেতে পারে কেউ ? জানি না । শুধু জানি পৃথিবীতে সত্যি কোনও রূপকথা নেই , তবু একথা জেনেও রূপকথায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি ।
যে মেয়েটি কালো , ভাবি সে কখনও সংসার পাবে , পাবে রাজপ্রাসাদ , তার জন্যে কোনও বি এম ডব্লিউ থামবে তারই বাড়ির দরজায় আর সেখান থেকে নেমে আসবে সুপুরুষ ফরসা রাজকুমার । যে কখনও তাকে বলবে না তুমি কি গৃহকর্মনিপুণা ?
যে ছেলেরা প্রায় এক দশক ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে , টাকা দিতে পারেনি বলে যাদের চাকরি হয়নি  , যে ছেলেরা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল ---- শুধু টাকা দেবে না বলে কোনও সরকারি কর্ম জুটলো না , যারা মাস্টারমশাইকে দেখতে পেলে বলে , স্যর আমাদের সময়টাই ভুল , সে ছেলেদের জন্যে কেউ আসবে রূপকথা থেকে , কৌটোর ভ্রমর খুলে বের করবে ডাইনি রাজ্যের প্রাণভোমরা , মেরে ফেলবে । তারপর সুখে শান্তিতে ...
আচ্ছা , রূপকথা , সুখে শান্তিতে কি কোনোদিন থাকা হবে না আমাদের ? এবারের ডিসেম্বরে কি জিংগলবেল বাজিয়ে সান্টা আসবে না , তার ব্যাগ থেকে বের করবে না নতুন একটা দিন !ফুরফুরে এক রোদের বড়দিন ! হাসপাতালের রোগীরা , ফুটপাথের শীতে কাঁপতে-থাকা মধ্যবয়সী পাগলিনী আর তাঁর সন্তান কি তাদের অভিশাপ শেষ করে ঝকঝকে শরীর নিয়ে এসে দাঁড়াবে না সবার মধ্যিখানে   !

দাঁড়াবে না । কারণ আমরা কেউ রূপকথা হতে চাইনি ।


দুই .
এক ছিল গরিব মানুষদের দেশ । সেই দেশে রাজা ছিল , রাণি ছিল । ছিল বণিকেরা । কয়েকজন ধনীও ছিল সেখানে  । সে দেশের ছিল অসংখ্য অসুখী সাধারণ নিম্নসাধারণ যাদের টাকায় চলত সেই দেশ । সেই দেশে ছিল অনেক অনেক রাজপ্রাসাদ । আর ছিল পাইক বরকন্দাজ পুলিশ সৈন্য সামন্তেরা । সেই দেশে ছিল অসংখ্য খবরের কাগজ । সেই কাগজ দিয়ে সে দেশের সাধারণ মানুষ দেশের হালহকিকতের খবর পেত । সেইসব কাগজ থেকে প্রতি রাতে উঠে আসত একটা খবরের কাগজের অতৃপ্ত আত্মা , সে এসে সেই দেশের লোকদের কী সব মন্ত্র দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো ।সাধারণ মানুষের কানে কানে ফিসফিস করে বলত – শোনো তুমি স্বাধীন , তুমি স্বাধীন , এই দেশে তুমিই রাজা , আসলে আমরা সবাই রাজা এদেশে । ফিসফিস করে বলত , এদেশে সবকিছুতে তোমার অধিকার আছে , আকাশ , মাটি ,নদী  সবকিছুতে । সেই না শুনে আনন্দে পাগল হয়ে যেত সে দেশের মানুষজন ।
সেই দেশের একটা ছোট্ট গ্রামে পাতা দিয়ে গড়া একটা জনপদে থাকতো গরীব মায়ের একটি সন্তান । সে খুব মেধাবী । তাদের গ্রামের থেকে অনেক দূরে একটা ইস্কুল । সেই ইস্কুলে সে পড়তে যায় । সেইসব পড়া সে পড়ে যেখানে এই কথা আছে যে তার দেশ কত বড়ো , কতো গৌরবময় তার অতীত , কত কষ্ট তার মানুষজনের  ... সেই সব পড়া । সেই ছেলেটির মা বড়ই দুঃখী , ভারি গরীব , রাত্রিবেলায় লণ্ঠনের আলোটুকুই তার সম্বল  । ছেলেটির নাম করুণ ।
করুণ তো তার মাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে মা , আমরা স্বাধীন ? মা আমরা কি স্বাধীন ? মা বলেন হ্যাঁ বাবা । একদিন আমাদের এই দেশ ছিল কিছু অত্যাচারীদের দখলে , এখন আমরা স্বাধীন । করুণ বলে ,মা স্বাধীনতা কাকে বলে ? মা বলেন , যেখানে সবাই রাজা হয় । সবাই সবার কথা শোনে । যেখানে একটা দেশ চালায় সাধারনেরা । বরুন জিজ্ঞেস করে , সাধারণ কারা ? এই আমরা বাবা আমরাই সাধারণ । আমরা কেন সাধারণ মা ? এইসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে মা বলত বড়ো হও সব বুঝতে পারবে ।
করুণ যখন তেপান্তরের মাঠে এসে দাঁড়াত , মাঠ যেন তাকে কিছু বলতে চাইত । করুণ যখন নদীর সামনে এসে দাঁড়াত , নদীও যেন কিছু বলতে চাইত , আকাশের দিকে মুখে উঁচু করে দিলে সেও যেন কিছু বলতে চাইত তাকে । করুণ সেইসব কথা কিছু বুঝতে পারতো না । সে বাঁশপাতার পতন দেখত একমনে ...কীভাবে পাতাটা ঘুরে ঘুরে পড়ছে মাটিতে , দেখে বিস্মিত হত করুণ । বিস্মিত হতে হতে সে বড় হয়ে গেল একদিন । সে এখন পাকা রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে কলেজ যায় লাইব্রেরি যায় , পড়াশোনা করে ... কয়েকজনকে পড়ায় , মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয় , মা-কে বলে আর কিছুদিন মা আর কিছুদিন ...
একদিন নদীর সামনে সে এসে দাঁড়িয়েছে , হঠাৎ শুনল একটা ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না ; চারপাশে দেখল কিন্তু নাহ কেউ কোত্থাও নেই ... কে কাঁদছে তাহলে ... সে ভাবতে লাগলো । তেপান্তরের মাঠের সামনে দাঁড়িয়েও একই রকম হল একদিন । মনে হল কেউ যেন কাঁদছে । সে বললো
কে ওখানে ?
কেউ বললো , আমি তেপান্তর
কাঁদছ কেন ?
আমার বড়ো কষ্ট ।  
কেউ বললো ,আমি নদী
কাঁদছ কেন ?
কেউ বলল আমি মাটি
কাঁদছ কেন ?
বিক্রি হয়ে যাচ্ছি আমি
সমবেত কান্নার আওয়াজ এইবার শুনতে পেল সে । আকাশ মাটি নদী কাঁদছে । বলছে শোনো ভাই আমাদের বাঁচাও , অন্তত একটা ব্যবস্থা তো করো ।করুণকুমার ভাবলো এই দেশে এইসব কী করে চলতে পারে । আর তাছাড়া আমরা তো স্বাধীন । এই না ভেবে সে ঠিক করলে সেই দেশের মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে সে । তার মা বলল যাস না খোকা , ওদের অনেক ক্ষমতা , ফিরে আয় । করুনকুমার বলল দেখো না কী করি । সে জিজ্ঞেস করলো নদীকে- কে বিক্রি করে দিচ্ছে তোমাকে । সে জিজ্ঞেস করলো মাটিকে কে তোমায় বিক্রি করছে । জবাব এলো এই দেশ । তখন তার মনে প্রশ্ন এলো এই দেশ যে চালায় আসলে সে তো সাধারণ মানুষের ভৃত্য , তাহলে নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে কথা বলে এর কোনও সমাধান হতে পারে ।
            এই না ভেবে করুণকুমার চলল তার সেই রাজ্যের রাজধানীর উদ্দেশ্যে । সেখানে বিরাট বিরাট প্রাসাদ , অট্টালিকা , বড় বড় রাস্তা , এসব দেখেই তার চোখ ধাধিয়ে গেল ।সেইদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেখা করতে চায় । আবেদন করে যায় সে । দেখা করার অনুমতি পায় না । একজন রাজকর্মচারীকে দেখে সে কিছু বলতে গেল , দেখল সেই কর্মচারী আগে থেকেই সবকিছু জানে । তাকে দেখেই রাজকর্মচারীটি বলে উঠল নদী বিক্রি আকাশ বিক্রি ? আরে শোনো বাপু মন্ত্রীর এইসব বাজে কাজে মন দেয়ার সময় নাই ।
কারোর সঙ্গেই তার দেখা হল না । কাউকেই সে বলতে পারল না নদী আর আকাশের কষ্টের কথা । তার যে-কটা মোহর ছিল সঞ্চয়ে সেটুকুও গেল শেষ হয়ে । বড় বিপদে পড়ে গেল সে ।  শুধু অস্ফুটে বলল কিন্তু আমরা তো স্বাধীন কিন্তু আমরা তো স্বাধীন । তার পাশে একজন ভিক্ষুক ফিক করে হেসে বলল আরে যুবক উহারাও তো স্বাধীন । করুণকুমার বলল , কাহারা ? ওই যে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী রক্ষামন্ত্রী এঁরা !
            কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল করুণকুমারের । সে আবার ফিরে এলো তার গ্রামে । পাতার জনপদে । যেখানে সে নদীর সঙ্গে কথা বলে , গাছের সঙ্গে , আকাশের সঙ্গে কথা বলে , সেখানে সে ফিরে এলো । তাকে পেয়ে তার মা তো যারপরনাই খুশি , কেঁদে ভাসিয়ে দিল তার মা । করুণকুমার সেদিন অপরাহ্নে খুব বিষণ্ণ হয়েই থাকল ।
            সেদিন রাত্রের অন্ধকারে কিন্তু কয়েকজন ঘাতক চুপিসারে প্রবেশ করলো তাদের গ্রামে । তারা দীর্ঘদেহী , কালো রঙ তাদের পোশাকের , হাতে অস্ত্রশস্ত্র । তারা করুণকুমারের শয্যার পাশে দাঁড়ালো আর নীরবে হত্যা করলো করুণকুমারকে । এইবার করুণকুমার সত্যিকারের বড় হল । আর বুঝতে পারল সে কেন সাধারণ । মৃত্যুর আগে তার ঠোঁটদুটো শুধু একবার নড়ে উঠে বলেছিল , কিন্তু আমরা তো ...
            করুণকুমারের গা থেকে সেই রক্ত বেড়িয়ে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত জনপদে , সূর্যোদয় লাল হয়ে উঠলো , রক্তরঙা গা নিয়ে বেড়িয়ে এলো হাজার হাজার মানুষ যাদের মুখে শুধু একটাই আওয়াজ , স্বাধীনতা স্বাধীনতা ...

তিন .  
আমি যদি সত্যি কোনও প্রতিবাদ করে থাকি তাহলে তোমাকে ভুলব না করুণকুমার  , আমি যদি কোনোদিন নদীর সঙ্গে গাছের সঙ্গে আর আকাশের সঙ্গে কথা বলতে পারি তাহলে তোমাকে কথা দিচ্ছি মা আমি কখনও এমন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে যাবো না , আমি যদি কোনোদিন গ্রিসদেশের প্রজাতন্ত্র পড়ে থাকি তাহলে কোনদিনও ভুলব না কীভাবে একটা রূপকথার চক্রান্ত করে তৈরি হয়েছিল আমাদের এই দেশের দায়সারা গণতন্ত্র ...

আমি নিজে তো রূপকথা হয়ে উঠতে পারিনি শুধু ভুলে যাইনি বরুণকুমার-কে ।একটি রূপকথার নাম বরুন বিশ্বাস ।



No comments:

Post a Comment