Sunday, December 16, 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে






"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে পাখ-পাখালীর শব্দ নাই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নাই!-রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন।

চলিতে চলিতে, অনেক দূর গিয়া রাজপুত্র দেখিলেন, বনের মধ্যে এক যে রাজপুরী-রাজপুরীর সীমা। অমন রাজপুরী রাজপুত্র আর কখনও দেখেন আই। দেখিয়া রাজপুত্র অবাক হইয়া রহিলেন।

রাজপুরীর ফটকের চূড়া আকাশে ঠেকিয়াছে। ফটকের দুয়ার বন জুড়িয়া আছে। কিন্তু ফটকের চূড়ায় বাদ্য বাজে না, ফটকের দুয়ারে দুয়ারী নাই।

রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন।

রাজপুরীর মধ্যে গিয়া দেখিলেন, পুরী যে পরিস্কার, যেন দুয়ে ধোয়া,-ধব্ ধব্ করিতেছে। কিন্তু এমন পুরীর মধ্যে জন-মানুষ নাই, কোন কিছুই সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না, পুরী নিভাজ, নিঝুম,-পাতাটি পড়ে না, কুটাটুকু নড়ে না।

রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া গেলেন।

রাজপুত্র এদিক দেখিলেন, ওদিক দেখিলেন পুরীর চারিদিকে দেখিতে লাগিলেন। এক জায়গায় গিয়া রাজপুত্র থমকিয়া গেলেন! দেখিলেন, মস্ত আঙ্গিনা, আঙ্গিনা জুড়িয়া হাতী, ঘোড়া, সেপাই, লস্কর, দুয়ারী, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

রাজপুত্র হাঁক দিলেন।
কেহ কথা কহিল না,
কেহ তাঁহার দিকে ফিরিয়া দেখিল না।"

( দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার-এর ঠাকুরমার ঝুলি'র ঘুমন্ত পুরী শীর্ষক গল্পের অংশ)



সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী
                            হিন্দোল ভট্টাচার্য শমীক ঘোষ


যোগাযোগ  ও লেখা পাঠানোর ঠিকানা - abahaman.magazine@gmail.com


দুটি কবিতা- চৈতালী চট্টোপাধ্যায়






ভালোবাসা

স্বপ্নে তাকে নুনের মতো লাগে।
ছড়িয়ে আছে ব্যঞ্জনে,লাউশাকে।
এ উপমায় প্রেম কি বোঝা গেল,
সুদূর থেকে গন্ধ ভেসে এল,
কালোজিরের।গোলাপবাগান ছেড়ে
তেলচিটে তাক।পাত্রখানি পেড়ে,
আহার সাজাই।থালায় রাখি ওকে।
রান্নাঘরে জড়িয়ে গেছি খুব!
পাঁচমিশালি স্বাদে ও সবজিতে
তূমি-ই আমার ভিটামিনের রূপ


খুনি

কে সমস্ত গুড় চেটে নিয়ে শুধু তেতো রেখে গেল!
কে আজ ঘরের চাবি জলে ফেলে দিল!
কে আলোর মুখ বেঁধে, সমূহ আঁধার
পথে-পথে ছড়িয়ে রাখল!
কে লিখবে প্রতিবাদ,সে কখন পোকা-পড়া ঘুমের পুকুরে নেমে গেছে!
এত ভয়! এতদূর অনিশ্চয়!
'প্রেম' মুছে দিয়ে দেহে এই আমি 'মৃত্যু' সাজালাম

Saturday, December 15, 2018

ধারাবাহিক গদ্য- চন্দন ঘোষ





চিকিৎ"শকিং"ডায়েরিঃ গোলঘর না পাগলঘর


 গোলঘর হাসপাতালে আসা ইস্তক শান্তিতে নেই সৌম্য। এ এক অদ্ভুত বিটকেল জায়গা। একটা ঢিল ছুঁড়লে হয় জুটমিল নয় মদের ঠেকে গিয়ে লাগে। এখানে বাবা ছেলেকে বকাঝকা করে ছুরি বার করে। শ্যামনগর আর কাঁকিনাড়ার ঠিক মাঝামাঝি এই জগদ্দল স্টেশন। আর তার পাশেই এই বিখ্যাত "গোলঘর" হসপিটাল। মাঝেমাঝে মনে হয় যেন বিহারে আছি। 
#
প্রথম দিন তো এমার্জেন্সিতে সৌম্যর বউনি হয়েছিল ৩০টাকা ধার না শোধ করার জন্যে গলায় বল্লম মারা কেস দিয়ে। চোখের সামনে জোয়ান ছেলেটা ছটফট করতে করতে টেঁশে গেল। তারপর জুয়ার আড্ডায় ছুরিমারামারি। দশাসই একটা লোক। তাকে দুজন মিলে ধরে নিয়ে এল। লোকটা পেট ছুরির ঘায়ে ছয় ইঞ্চি ফাঁক। নাড়িভূড়ি বেরিয়ে এসেছে আর লোকটার দুহাতে ধরে রেখেছে নিজের নাড়িভুড়ি। লোকটার জ্ঞান তখনও বেশ টনটনেই। ওই অবস্থায়ই সে বলে ওঠে, ক্যা সাব ম্যায় জিন্দা রহুঙ্গা তো। বদলা লেনা হ্যায় হামকো। জরুর লেঙ্গে হাম।  সৌম্য নিজের ভেতরের কাঁপুনিটা ঢাকতে ঢাকতে কী যে বলেছিল খেয়াল নেই।
#
আজ নাইট ডিউটিতে কার মুখ দেখে ঢুকেছিল কে জানে। সন্ধে রাতেই বার্ন কেস। যুবতি বৌটি রাগ করে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রায় সেভেন্টি পারসেন্ট বার্ন। আর বরটা তাকে বাঁচাতে গিয়ে দুই হাত পুড়িয়েছে। মেয়ের মাও সেই মর্মে বয়ান দিল। রিপোর্ট লেখা হল। চিকিৎসাও শুরু হল। ও মা! একটু বাদেই এক ঝাঁক মহিলা গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির শ্লোগান দিতে দিতে ঢুকে পড়ল হাসপাতালে। তাদের দাবি, এটা সুইসাইড নয়, অ্যাটেম্পট টু মার্ডার। বধূ নির্যাতনের কেস। তারা এও দাবি করছে, সৌম্যই না কি মিথ্যে রিপোর্ট লিখে শশুরবাড়িকে বাঁচাতে চাইছে। প্রায় ঘুষের ইঙ্গিত করে আর কি! সৌম্য তো মহা ক্যাচালে পড়ে গেল। তবে কিনা বিপদে যেমন প্যান্ট খোলে, তেমন বুদ্ধিও খোলে অনেকের। সৌম্য চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু মেয়ে তো অন্য কথা বলছে। তারা বলে বসে, চলুন আমরা শুনতে চাই সে কী বলছে। কী মর্মান্তিক দাবি। সত্তর আশি শতাংশ পোড়া মেয়েটি বিছানায় চেঁচাচ্ছে। জল, একটু জল দাও। তার চারপাশ ঘিরে ধরেছে মহিলা সমিতির বিপ্লবীনিরা। তার মধ্যে একা কুম্ভ সৌম্য প্রথমেই গুছিয়ে মোক্ষম প্রশ্নটা করে ফেলল, বল মা, তাহলে কী হয়েছিল, কী ভাবে আগুন লাগালে। মেয়েটি প্রবল যন্ত্রণার মধ্যে সত্যি কথাটাই বলে দিল। বলল, আমার বরের ওপর খুব রাগ হয়েছিল। তাই কেরোসিন তেলের বোতল মাথায় উপুড় করে দেশলাই মেরে দিলাম। উঃ! জ্বলে গেল, জল, একটু জল। বিপ্লবী দিদিমনিদের মুখ চুন। গোটা বিপ্লবটাই ভেস্তে গেল। ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে গেল। 
#
সৌম্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক বাবা, সে যে বেছে বেছে লিডিং কোশ্চেনটাই করেছে তা কেউ ধরতে পারেনি। এমার্জেন্সিতে ফিরে আয়েস করে একটা উইলস ফিল্টার ধরাল সৌম্য।

ধারাবাহিক গদ্য- দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়






                       ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে...যায়নি


দুটো ছেলেমেয়ের প্রেমের সম্পর্ক।
তারা কি ভালো বন্ধু হতে পারে?
উত্তর, না। আমার জীবনে অন্তত।
আপনি প্রশ্ন করবেন, কেন? আমি বলতে পারব না। বোকা হেসে বলব, হয় না। তাই। বলতে পারলে আমি নোবেল পেতাম।
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে রবি ঠাকুরের গান হেল্প করতে পারে। আর কবীরের গান। দুটি মানুষের ভেতরের সম্পর্কের মানবাত্মার সার ধরা এদের গানে। যেমন কবীর ভালোবাসাকে লিখেছেন, " আজন্ম সন্ন্যাসী", "শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রাণায়াম", " তুমি কি বোঝো না কেন সুর আসে বুকে"। কত উদাহরণ দেব। রবি ঠাকুর লিখছেন, "মিলনের বীজ অংকুর ধরে"। আরো হাজারো লাইন। যেগুলো আগের লেখায় বারবার কোট করেছি। কেউ কেউ একটা কারটেসি না দিয়েই সেগুলো শেয়ারও করেছেন দেখলাম।
ভালোবাসা কি?
সহজ ভাবে বলা যায়, যা দুটো মানুষকে এক করে দেয়। বাউলরা বলেন, এক থেকে দুই হয়। আবার দুই থেকে এক। একাত্মা। একক। যেখানে ব্রহ্মাণ্ড মিলে যায়। বিন্দুতে সিন্ধু। 
দুটো মানুষের সাজপোষাক, তাকানো, গলার আওয়াজ, লেখা গান, বোধ, ছোয়া, ভাবা, শব্দ, সুর, ঘরের আলো, আসবাব সব এক হয়ে যায়। আলাদা দুটো দেশে থাকলেও হয়। কথা না বলেই বোঝা যায় মেয়েটি কোথায় আছে এই বিকেলে। কি করছে। স্রেফ ফোনে কথা বলে। একটা না-দেখা সুতো বেধে দেয়। রবি ঠাকুর একে বলেন, " জানি বন্ধু জানি/ তোমার আছে তো হাত খানি।" "এই যে তোমার প্রেমের বাণী/ প্রাণে এসেছে"।একে ব্যখ্যা করা যায় না। করলে সভ্যতা নিভে যাবে।
তবে তার জন্য এক জনকে আরেক জনের ধারণ করার শক্তি রাখতে হবে। গতি হতে হবে সমান। এবং এটা বানানো যায় না। হয়।
আর তাই বন্ধু হতে পারে না প্রেমের সম্পর্কের দুটি ছেলে মেয়ে। কারণ, বন্ধুত্ব নগ্নতা চায় না। চায় স্বার্থহীন সম্পর্ক। প্রেম খুব ক্রুয়েল। অথবা ডুয়েল। নগ্ন ভাবে মারতে চায়। মেরে ফেলতে চায়। বাঘের মত। খুব ডিমান্ড করে। এত তার জোর। শক্তি। মনের এই দরজায় সবাই যেতে পারে না। পুতুল পুতুল বিয়ে করে হিসেব কষে নেয় অনেকে। অনেকে এক বিছানায় শুয়েও সারাজীবন টের পায় না, প্রাণের মাঝে সুধা আছে। বা, কখন ঘরেতে ভ্রমর এসেছিল, অন্ধকারে। বা কখনও ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে।
শিল্পী প্রতি যুগে এই প্রেম দিয়েই একটা দাগ কেটে যান। আর সে দাগে এসে যায় মক্কা-মদিনা। অন্তর যোগ দিয়ে কাটা এই দাগ জোড়ালো হয়। হয় সাধনার মত পরম। গানে রাখা থাকে এ চিঠি অথবা বিপ্লবে। শিল্পী এক মেয়ে থেকে তাই চলে যান জন্মভূমিতে। কামনা করেন শহর, উদ্যান, সান্ধ্যপল্লি, বন্দর। কবীর লেখেন, "সন্ধে হল সন্ধে হল/ এখন ঘরে ফিরছে যারা/তাদের মনে শান্তি আসুক/শান্তি আনুক সন্ধেতারা"।
সহজীবীদের জন্য এই এম্প্যথি শিল্পীর চূড়ান্ত অবস্থান। তখন আর একটা মেয়ে নয়। একটা জাতি। বিশ্ববাসী আমার আত্মার আত্মীয়। সহযাত্রী। 
কলেজে আমরা বলতাম, প্রেম করা যায় না। প্রেম হয়। রবি ঠাকুর লেখেন, "হাত দিয়ে দ্বার খুলবো না গো/ গান দিয়ে দ্বার খোলাবো..."। ঘটক যুক্তি তক্কে" দেখান অরণ্যে দুই যুবক যুবতী। নিঃশ্বাস বেড়ে চলেছে তাদের। অলখ্য থেকে এসে পড়ছে অপার আলো। তারপরেই নৈরাজ্য। কামনায় বিপ্লব। এখানে রবি ঠাকুরও চলে যান। কবীরও। সেটা এ লেখার প্রসঙ্গ না।

আমার প্রায় ৫০০ ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট জমে। তবু লোকে কে-জানে-কেন আমায় রিকু পাঠায়!
প্রতিদিন সকালে আমায় নানা বয়সী লোকে  সুপ্রভাত জানান। হয়তো অনেককেই জানান।
আমি ভেবে দেখেছি, এদের কোথাও না কোথাও আমায় দরকার। ইন্টারেস্ট আছে। আর আছে ইন্সিকিওরিটি। যা এ জাতকে গ্রাস করছে ক্রমশ দ্রুত।
২০০৫ এ এলো ফেসবুক। ২০১০ এ ওয়াটসএপ। দুনিয়ার সংযোগের ভাষা গেল বদলে। সবার পকেটেই এখন লাখ লাখ "ফ্রেন্ড" জ্বল-জ্বল করে। প্রত্যহ। স্নোডেনের বিপ্লব সম্ভব ছিল না ডিজিটাল ছাড়া। ওয়ালস্ট্রিট-ও তাই। জাফার পানাহি প্রবল রাষ্ট্রচাপেও বাড়ি বন্দি হয়ে ফোনে ছবি তুলছেন। ঘটক থাকলে, আমি বিশ্বাস করি, "সিনেমাকে লাথি মেরে" কমিউনিকেশনের এই নব্য ভাষাকে স্বাগত জানাতেন।
এটিএম। সিসিটিভি। ডিজিটাল। আর তার সাথে ফ্রেন্ড উইথ বেনিফিট!
সম্পর্কের নতুন নাম। মানে, প্রেম করেও ক্লেম করব না। পাছে ছক করে ব্লক হই! ইগো আছে ভাই। স্পেস চাই। তাই কেস না খাই।
প্রেমের সাথেই দোসর হয়ে চলে আসে পসেসিভনেস। একটু পসেসিভ না হলে আর কীসের প্রেম! মেয়েটা অন্য মেয়ের প্রশংসা শুনতে পারে না। মাঝে মাঝে তার সামনে নামটা বলে প্রেমটা ঝালিয়ে নেওয়া (নিন নারীবাদে রেগে উঠুন!)। এবং ভিসাভি। আমি একে কেন্দ্র করে মাত্রা তিরিক্ত মারামারির কথা বলছি না। কিন্তু সামান্য জলও যদি রসিয়ে রসিয়ে না ফোটে! ব্রোনো যদি টিপে টিপে না ফাটে..তবে আর কি হল...
কিন্তু এ সব আর পরমব্রত রাইমার সাথে আজকের ছবিতে হিন্দুস্তান রোডের লিভ ইন এ করে না। স্পেস লাগে ভাই! মাঝে মাঝে রাইমা ফোন করে দরকার মত মাঝরাতে " ভালো লাগছে না" ঘ্যানঘ্যান করে নেবে। বাকি সময় তার স্পেস লাগবে। সাফ কথা। তখন পরমব্রত মনের দুঃখে গিটার বাজাবে! কারণ তার স্পেস নেই। ফেস আছে, বুকে!
আমাদের সময়ের এ সব ভণ্ডামি নীচের ছবিতে স্পষ্ট। রবি ঠাকুর যতই লিখুন, যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে...রাঙিয়ে দিয়ে যাও...। কবীর যতই লিখুন, একটি মন আরেকটি মন ছুলে বিস্ফোরণ। বা, "সাপেরা বধির হয় সাপিনীরা শুধু সুর শোনে.."। গৃহযুদ্ধ ছবির শেষে মমতা শঙ্কর যতোই তার নকশাল প্রেমিক অঞ্জন দত্তকে রিফিউজ করুন, কেরিয়ারিস্ট হয়েছেন বলে!
যতটুকু দরকার ততটুকুই। তাই সকালে মেসেজ, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, বন্ধু সেজে সেটুকু হাসিল করেই উইকেন্ড। তা এমন সময়ে বিজেপি আসবে না তো কে আসবে!
প্রেম নিয়ে অনেক কথা লিখল। সে প্রেমের আলো এখনো অনলাইন। কিন্তু নীভু। প্রেম বা বিপ্লব বেশিদিন থাকে না। "যাওয়ার পথে আগিয়ে দিয়ে" তা চলে যায়। বিয়ে আর সরকার আবহমান প্রতিষ্ঠান। যার সাথে প্রেম বা বিপ্লবের কোনও সম্পর্ক নেই।

মেয়েদের এক রকমের দেখা থাকে। হ্যা, পুরুষকে দেখা। যখন কামনা আসে। খিদে পায় তাদের। রবি ঠাকুরের ছবির চোখ যেন-বা। শিকারের আগে হরিণ-চোখ। জ্বলে ওঠে। দপ করে। যেভাবে চতুরঙ্গের দামিনী দেখে। দেখে, মেঘে ঢাকা তারা-র নীতা। জানলার ফাক দিয়ে। নিয়ম ভেঙে। ওই উপন্যাসে তারপর গুহা অধ্যায় আসে। যা দাবানল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেরানির বউ" মনে পড়ছে। প্রসঙ্গত, ফিমেল গেজ নিয়ে মারি আন দোয়ানের চমৎকার কাজ আছে। 

পুরুষদের মেয়েদের দেখা নিয়ে অজস্র কাব্য সাহিত্য। অন্যতম সেরা কাজ রলা বারত এর। কীভাবে আমরা অবজেক্টিফাই করি মেয়েদের। আমাদের অরুণকুমার সরকার প্রতিভা বসু-কে উৎসর্গ করা কবিতায় লেখেন, ওই দু চোখের পরশ কি যৎসামান্য পাওয়া যাবে। আরও কত। 

যেমন মেয়েদের ভাষাও থাকে। নিজস্ব। এই উত্তর আধুনিক নারীবাদের দিনেও থাকে। কোনও একটি মেয়েকে কোনো পুরুষ প্রোপোজ করলে, জোর উত্তেজনা লাগে মেয়েটির বান্ধবীদের মধ্যে। চলে প্রবল খিল্লি। তখন এ ধরণের ভাষা শোনা যায়। বা, শোনা যায়, সন্তান প্রসবের আগে, আতুর ঘরে।

কিন্তু মেয়েদের দেখা। মাধবীলতা যে ভাবে অনিমেষকে দেখে। বা, কবীরের একটি গানে নারী কন্ঠ গান, "এখনো সেই পাঞ্জাবিটা/ হারিয়ে যাওয়া সেই চাবিটা/কেমন আছো?" বা, পুরুষের জামার বোতাম ভাঙা কিন্তু খেয়াল নেই। মেয়েটি তা দেখে ফেলছে। এই মেটাফর অনেকেই ব্যবহার করেছেন। জোন বায়েজ যেভাবে ডিলানকে গান। টু ববি। বড় মায়ের মত এ সব দেখা।

ঘরেতে ভ্রমর আসে গুনগুনিয়ে। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়। এ সব ধরা পড়ে, গলার আওয়াজে। ছোয়ায়। তাকানোয়। শব্দ চয়নে। যখন নায়ক ছবিতে শরমিলা বলেন, "মনে, রেখে দেব"। বা, মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস হ্যায়...বা,বাঙালি মেয়েদের চিরাচরিত ডায়লগ, " ভালোবাসা" আর "ভালোলাগা" আলাদা...বুঝতে শেখো..

আর, বিরহ? সেও বড় বেদনার। রবি ঠাকুরের ছবিতেই নারীচোখ তার প্রমাণ। কি প্রশান্ত। কি হিংস্র। তারিয়ে তারিয়ে কাটে। যেখানে প্রেমের পাওয়ার প্লে শেষ। সাইলেন্স শুরু। যেন সাইবেরিয়ার শীত। কি ঠান্ডা। ব্রাত্য দারুণ লিখেছিলেন, আপাতত এভাবে দু জনের দেখা হয়ে থাক নাটকে, যে লেখক-বরের লেখায় এতদিন অবসেসড ছিলেন স্ত্রী, বিচ্ছেদের সময় তা পুড়িয়ে ফেলছেন বর। স্ত্রী চলে যাওয়ার আগে শান্ত ভাবে দেখছেন। কোনো এম্প্যথি নেই। ব্রাত্য লেখেন, কী ভয়ানক শান্ত ওই চোখ। যেন পরম শত্রুরো দেখতে না হয়। মরা মাছের চোখ যেন। ওহ!

ভেতরে না বাইরে?
ঈশ্বর, জগৎ, ব্রহ্মাণ্ড, প্রেম কোথায়?

লালন ও রবি ঠাকুর বলবেন, ভেতরে তাই বাইরে। ফ্রয়েড খুজবেন ভেতরে। Marx বাইরে। বিবেকানন্দও বাইরে। কারণ তাকে রামকৃষ্ণ বলবেন, তুই এত স্বার্থপর বিলে! শুধু নিজের ভেতরেই সব আছে জেনে সন্তুষ্ট থাকবি!!

রামকৃষ্ণর সমাধি দশা আজকাল ভাবায়। ভাবায়, মানুষের বোধিপ্রাপ্তি। লোক দেখেই বুঝে যাই, কার ভেতরে বোধিলাভ একটুও ঘটেছে আর কার কোনওদিন ঘটবে না।

এই যে আপনি বারবার বিয়ের সেল্ফি তুলে ছুড়ে মারছেন, আসলে তো আপনি নিজের থেকেই বিচ্যুত। হতে পারে আপনার বয়স ৭০। কিন্তু আপনি গ্রো করেননি। আত্মমগ্ন হননি। ঈশ্বর নেই আপনার মধ্যে। প্রেমের আগুন জ্বলেনি। পুড়ে যাননি। তাই আপনি এত কথা বলছেন। আসলে আপনার নিজের কোনও কথা নেই। ভাষাহীন আপনি। উজবুক।

অথবা, আপনি খেলছেন। স্বপ্নের ব্যখ্যায় যেমন ফ্রয়েড শুরুতে খেলার কথা বলছেন। আমরা ছেলেবেলায় সবাই খেলি মাঠে। বড় হয়ে মাঠ পাই না। কিন্তু খেলি। কখনও তা প্রেমে বা কখনও গল্পলেখায়। খেলতে থাকি। খেলা থামে না।

রবি ঠাকুর বলছেন, যে আমার নতুন খেলার জন/ তারই এই খেলার সিংহাসন। বলছেন, চোখের আলোয় দেখেছিলেম/ চোখের বাহিরে। এই হৃদকমলে রাঙাবে উত্তরীয়...সমাজ সংস্কারক এ দেশে কম আসেননি কিন্তু মনের সংস্কার? 
রবি ঠাকুর মনের গভীর এই বনের গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে গেলেন। যা জাতির ডিএনএ। বিন্দুতে সিন্ধু। যেখানে প্রেম। সমাধি। বোধি। আলো।

নীতা কি চেয়েছিলেন?
একটা ঘর। সংসার। জীবন।
যখন তার দাদা তার শিলং এর মানসিক হাসপাতালে গিয়েও জানায়, বাড়ির সবাই খুব আনন্দে আছে, বাচ্চা-কাচ্চা হয়েছে সবার, হইচই, নীতা কথা থামিয়েই চিৎকার করে

দাদা আমি কিন্তু বাচতে চেয়েছিলাম

ক্যামরা ৩৬০ ডিগ্রি প্যান করে ঘুরতে থাকে। আসমুদ্র হিমাচল একাকার হয়ে যায় সে চিৎকার। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ভেঙে তছনছ করে। ছিটকে এসে রক্ত লাগে সমগ্র পুরুষতন্ত্রের সাদা পাঞ্জাবিতে।

রবি ঠাকুর নীতাকে নিয়ে গান লিখলে লিখতেন, সকল গৃহ হারালো যার...। ঋত্বিক গ্রেট শিল্পীদের মতোই বড় নিষ্ঠুর। যেমন রবি ঠাকুরও। কিন্তু তারা কি জানতেন, আর তিন দশকের মধ্যে মেয়েদের ভূমিকার এমন বদল ঘটবে? সমাজের ভারসাম্যই যার জন্য যাবে বদলে?

আমার প্রজন্মেই ব্যপক হারে মেয়েরা সিঙ্গল ওমানহুড চাইল। পাশ্চাত্যে অনেক আগেই এই মোটিফ দেখা গিয়েছিল। আমাদের এখানেও ছিল। কিন্তু এত ব্যপক হারে হয়তো না। মেয়েরা আর "সংসার" চাইল না। কলেজ পাশ করার পর, তারা অনিশ্চিত কোনও একটা কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে লিভ-ইন করে নিল। দেখল, এ আসলে সংসারেরই ব্যপার। নতুন বোতলে পুরোনো মদ। তাকেই চাকরি থেকে ফিরে রান্না করতে হচ্ছে। তো, সেই মেয়ে বেরিয়েও এলো। কলকাতা মা-বাবা"র কাছেই ফিরে, কুকুর/বেড়াল পুষে, কম্পুটারে কাজে ঢুকে গেল। মাঝেসাজে এদিক ওদিক ফ্লারট করে নিল। যেমন পুরুষরাও করে।

জোর দিয়ে বলব, ব্যপক হারে আমার প্রজন্মে এই মোটিফ দেখা গেল। মেয়েদের মধ্যে। আমাদের আগের প্রজন্মের লেখায় এই মোটিফ আসেনি। সন্দীপন খুব কাছে গেছেন। কিন্তু না, এই চিহ্ন নেই। ধরার সুযোগ পাননি। নবারুণ অন্য ভাবে ধরেছেন, "বেবি কে" জাতীয় লেখায়। 

আপনি বলবেন, মেয়েরা ফেমিনিটি হারালে তো ঘর ও বংশ ও রাষ্ট্র টলে যাবে। আমি একমত হব না। এটা ঠিকই ফেমিনাজিরা বদলা নিতে চায়। কারণ যুগ যুগ ধরে পুরুষ তাদের পুজো করেছে আর রড ঢুকিয়েছে। কিন্তু এমন অনেক মধ্যবিত্ত পড়ালেখা জানা নারী আগের প্রজন্মের আমি দেখেছি, যাদের স্পেস চাইতে আদালত বা ফেসবুকে আসতে হয়নি। তারা সংসার সামলেই নিজের অধিকার বুঝে নিয়েছেন। আর সে সংসারে কোনো এক্সপ্ল্যেটেশন নেই। আমার চারপাশে যে বন্ধুরা বিয়ে বা সম্পর্কে আছেন, এমন ভাবেই আছেন। আমি তাদের মধ্যে আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ দেখতে পাই। দেখি ধানখেত আর নারকেল গাছ।

একটা শিশু ছোয়া চায়। বুকের লাবডুপ চায়। না পেলে, সে ভায়োলেন্ট হয়। ইন্টলারেন্ট হয়। যেমন মানুষের ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি আসছে সেই পথেই। শীতকাল কবে আসবে সুপরণাই জানেন। নয়তো বড্ড বেশি ঠান্ডা লাগবে। নীতার সাথে যা হয়েছে তা মানা যায় না। কিন্তু তা বলে নীতা ঘরের স্বপ্ন না দেখে নাজি হবে তাও তো মানা যায় না? আপনি আমায় লারজ ভন ট্রায়ার বেস মোয়া দেখালেও যায় না। বাভোয়া নিজে ঘরে ছিলেন। সংসার আর নারীবাদের রসায়নটা নিয়ে কি আরেকটু ভাববেন নারীবাদীরা? আমরা পুরুষরা তো মাথা নীচু করেই আছি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। আগের প্রজন্মের দায় শোধ করছি। 
কিন্তু তোরা কি আরেকটু ভাববি? সবাই না কেউ কেউ। সন্তানের দোহাই!

এ সব শীতে তাই মায়ের প্রসব ব্যথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, মার দিকে তাকানো হয়নি বহুদিন। সারা জীবন মা ঘুমননি ভালো করে। কারণ আমার স্কুলবাস এসে  যাবে। কারণ আমার কলেজ আছে। কারণ আমার অফিস। মনে পড়ে, মার দিকে তাকানো হয়নি বহুদিন, ভালো করে। মায়ের প্রসব ব্যথা মনে পড়ে। পাপবোধ হয়। ছেলেবেলার খেলনা মনে পড়ে। মনে পড়ে সাবানের গন্ধ। কুয়াশা ঘিরে ধরে শহর। মানুষ আস্তে কথা বলে। নিজেদের গরম জামায় সাজিয়ে রাখে। মনে হয় শহরের কি-যেন-এক রোগ হয়েছে। যা, সারবে না। আইসিইউ তে। কোমায়। তবু খুচরো রোদ সেই ঘা ঢেকে দেয়। মাঝেসাজে। বাহারি টুনি জ্বলে সবুজ পাতার ফাকে। কাফে। মেরুন-হ্লুদ ফুল ফোটে। দ্রুত সন্ধ্যা নামে। হলুদ ল্যাম্পোস্টের স্পটলাইটে হাতে-হাত হেটে যান শম্ভু আর তৃপ্তি মিত্র।

খুব ছোটবেলার হিন্দি সিনেমায় ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে মাধুরী দীখ্যিতের দিকে তাকিয়ে মরে যাই। "তুম সে মিলকে..এয়সা লাগা তুমসে মিলকে" যে ভাবে গান মাধুরী। সন্দীপনের মতো বলতে ইচ্ছে করে, আমার আর কোনও অসুখ নেই। ইচ্ছে করে শুধু শুনে যাই, "প্যাহেলা নেশা প্যাহেলা খুমা"। প্রথম প্রেমিকাকে মনে পড়ুক। মনে পড়ুক, আমাদের এইট-বি তে বসে থাকা। আজ কাল পরশু তরশু। রাত আটটা। দোকান বন্ধ করছে মাসি। সামনে নিভে আসে কলকাতা। আমাদেরো বাস ধরতে হবে। আমাদের মাথায় কেউ জল ঢেলে দেয়। তার পর অপঘাতে কাটা দুটো লাশ মেলে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোয়।

বড় অসুখের কথা মনে পড়ে এ শীতে। তাই গোয়া চলে যেতে ইচ্ছে করে। সবাই যেমন পালচ্ছে। আমিও পালাতে চাই। কিন্তু দিনান্তে ইন্দির ঠাকুরণের মতো ফিরেও আসি। গজগজ করতে করতে। মা-র কথা মনে পড়ে। 

মনে পড়ে মা-র প্রসব যন্ত্রণা। মনে পড়ে মার দিকে তাকানো হয়নি বহুদিন ভালো করে। কারণ, মা ধরে ফেলবে আমি যন্ত্রণা পেয়েছি। প্রসব যন্ত্রণা। ১০ মাস ১০ দিনের। নিজে হাতে খুন করেছি প্রেম। করতে হয়েছে। সুপারি দিয়েছে সময়। মা জানত, আমি ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিলাম। তাই বুঝতে পারবে না, কেন এমন লাশকাটা ঘরের মত ঠান্ডা শহর। প্রেমের শহর। কেন সবাই পালাচ্ছে। আর বিয়ে করছে। আর কুয়াশায় আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আরো। আরো।

মানুষ মারা যাওয়ার আগে কিছু কথা বলে যায়। প্রেমিকা ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন কিছু কথা বলে।
এ সব কথার ওজন খুব বেশি। সবার নয় এ সব কথা। বৌদ্ধরা তাই ভাইব্রেশন বুঝে, যার বুকে বুদ্ধ আছে, তাকেই বলে যান এ সব।

কেউ তার বই দিয়ে যান লাইব্রেরিতে। কেউ ফ্ল্যাট দিয়ে যান মিশনকে। কেউ অস্ত্র দিয়ে যান লড়াইয়ের। কবীরের গানে, কোনও সন্তানহারা মা জোড়া মুনিয়ার খাচা খুলে দেন।

দিদা সুরমা ঘটক যেমন বলতেন, ঋত্বিককে তো বাচিয়ে রাখতে হবে! সঞ্জয়দা কাল যখন বলছিলেন, নীতাকে লো এঙ্গেলে যে রাতে মোর গানে ঘটক যেভাবে দেখেন তা বুজোয়াদের এতাবৎকালের সব দেখা ভেঙে দেয়। আমি দেখলাম, ওই মুহূর্তে ঘটক বেচে উঠলেন। বেজে উঠলেন। ঋত্বিক যুক্তি-তক্কো"র শেষে  যখন বললেন, কিছু একটা করতে হবে তো...মানিকবাবুর মদন তাতি মনে কর..সেটা তার অন্তিম উচ্চারণ। সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরলো তাতে।

প্রতুলদার গান নিয়ে একটা বড় ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তাতে উনি বলেছিলেন, মা মারা যাওয়ার আগে যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মনে হচ্ছিল, সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরতে চাইছে। ঢুকে আসছে শরীরে। ট্রান্সমাইগ্রেট করতে চাইছে। যেমন পুশকিনের আত্মা ডস্টভয়স্কির শরীরে ও পরে কালভিনোর শরীরে ঢুকে যায়।

আমি মানুষকে মারা যাওয়ার মুহূর্তে দেখেছি। আপনারা দেখেছেন? দেখেছি পায়খানা করে ফেলছে মানুষ। বা মদ ঢেলে দিচ্ছে স্ক্রিনে। বা, দেবদূতের মতো পরীর হাতে বিলিয়ে দিচ্ছে আত্মা। নীল চোখ নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ছে কফিনে। গুরুস্থানীয় কিছু মানুষ আমায় কিছু কথা বলে গেছেন। যা, আমি এ জীবনে কাউকে বলতে পারব না।চেষ্টা করব, সে কথার সম্ভ্রম রাখতে, কাজে।

মাঝে মাঝে, মারা যাওয়ার কথা ভাববেন। দেখেবন মনে হবে, সমুদ্রের সামনে বসে আছেন। বুনুয়েল যেমন ডাইরিতে রীতিমত ফ্যান্টাসি করে ফেলেছিলেন কীভাবে মারা যাবেন তা নিয়ে। বাথরুমে না দেবালয়ে। প্রেমিকাদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোর কথাও ভেবে গেলেন পরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আগে।

ট্রেন যদি জীবন হয়, কাশবন পেরিয়ে অপু কিন্তু তা দেখতে পেল, দুর্গা পেল না। পা মচকে পড়ে গেল। নারীবাদী ব্যখ্যায় রুশতী সেন এমনটাই লিখেছিলেন। বা, অপরণা"র মারা যাওয়ার খবরে থাপ্পর মারে শিল্পী অপু। মুখ বেকে যায়। মাও বলেন, কারও মারা যাওয়া পাহাড়ের মত ভারি আর কারো পালকের চেয়েও হালকা।

সন্দীপনের লেখা প্রসঙ্গেই একবার সঞ্জয়দা লিখেছিলেন, সন্দীপনের লেখা জুড়ে সম্প্রসারিত এপিটাফ। সমস্ত লেখক জীবনানুগ হলে সন্দীপন মৃত্যু অনুসারী।

মানুষ মরে যায় ঠিকই। মানব থেকে যায়। আর তাকে অগ্রজের কাজের ভারও শোধ করতে হয়, এক জীবনেই। চুল্লিতে হাত-পা-মাথা-ঘিলু ফেটে যাওয়ার আগে!


কুন্তল মুখোপাধ্যায়- করুণকুমারের গল্প





পৃথিবীতে সত্যি কোনও রূপকথা নেই , অথচ গল্পে আছে । অনেকে বলেছেন বাচ্চাদের রূপকথা শোনানো অথবা পড়ানো উচিত নয় । অথচ আমাদের ছেলেবেলা রুপকথাচিহ্নিত হয়ে আছে । কী হয় রূপকথা পড়ে ? সেখানে যেসব চরিত্র আছে তারা কি এই পৃথিবীর কেউ নয় ?  সেসব কাহিনী পড়লে কি অবাস্তব বোধসম্পন্ন হয়ে যেতে পারে কেউ ? জানি না । শুধু জানি পৃথিবীতে সত্যি কোনও রূপকথা নেই , তবু একথা জেনেও রূপকথায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি ।
যে মেয়েটি কালো , ভাবি সে কখনও সংসার পাবে , পাবে রাজপ্রাসাদ , তার জন্যে কোনও বি এম ডব্লিউ থামবে তারই বাড়ির দরজায় আর সেখান থেকে নেমে আসবে সুপুরুষ ফরসা রাজকুমার । যে কখনও তাকে বলবে না তুমি কি গৃহকর্মনিপুণা ?
যে ছেলেরা প্রায় এক দশক ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে , টাকা দিতে পারেনি বলে যাদের চাকরি হয়নি  , যে ছেলেরা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল ---- শুধু টাকা দেবে না বলে কোনও সরকারি কর্ম জুটলো না , যারা মাস্টারমশাইকে দেখতে পেলে বলে , স্যর আমাদের সময়টাই ভুল , সে ছেলেদের জন্যে কেউ আসবে রূপকথা থেকে , কৌটোর ভ্রমর খুলে বের করবে ডাইনি রাজ্যের প্রাণভোমরা , মেরে ফেলবে । তারপর সুখে শান্তিতে ...
আচ্ছা , রূপকথা , সুখে শান্তিতে কি কোনোদিন থাকা হবে না আমাদের ? এবারের ডিসেম্বরে কি জিংগলবেল বাজিয়ে সান্টা আসবে না , তার ব্যাগ থেকে বের করবে না নতুন একটা দিন !ফুরফুরে এক রোদের বড়দিন ! হাসপাতালের রোগীরা , ফুটপাথের শীতে কাঁপতে-থাকা মধ্যবয়সী পাগলিনী আর তাঁর সন্তান কি তাদের অভিশাপ শেষ করে ঝকঝকে শরীর নিয়ে এসে দাঁড়াবে না সবার মধ্যিখানে   !

দাঁড়াবে না । কারণ আমরা কেউ রূপকথা হতে চাইনি ।


দুই .
এক ছিল গরিব মানুষদের দেশ । সেই দেশে রাজা ছিল , রাণি ছিল । ছিল বণিকেরা । কয়েকজন ধনীও ছিল সেখানে  । সে দেশের ছিল অসংখ্য অসুখী সাধারণ নিম্নসাধারণ যাদের টাকায় চলত সেই দেশ । সেই দেশে ছিল অনেক অনেক রাজপ্রাসাদ । আর ছিল পাইক বরকন্দাজ পুলিশ সৈন্য সামন্তেরা । সেই দেশে ছিল অসংখ্য খবরের কাগজ । সেই কাগজ দিয়ে সে দেশের সাধারণ মানুষ দেশের হালহকিকতের খবর পেত । সেইসব কাগজ থেকে প্রতি রাতে উঠে আসত একটা খবরের কাগজের অতৃপ্ত আত্মা , সে এসে সেই দেশের লোকদের কী সব মন্ত্র দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো ।সাধারণ মানুষের কানে কানে ফিসফিস করে বলত – শোনো তুমি স্বাধীন , তুমি স্বাধীন , এই দেশে তুমিই রাজা , আসলে আমরা সবাই রাজা এদেশে । ফিসফিস করে বলত , এদেশে সবকিছুতে তোমার অধিকার আছে , আকাশ , মাটি ,নদী  সবকিছুতে । সেই না শুনে আনন্দে পাগল হয়ে যেত সে দেশের মানুষজন ।
সেই দেশের একটা ছোট্ট গ্রামে পাতা দিয়ে গড়া একটা জনপদে থাকতো গরীব মায়ের একটি সন্তান । সে খুব মেধাবী । তাদের গ্রামের থেকে অনেক দূরে একটা ইস্কুল । সেই ইস্কুলে সে পড়তে যায় । সেইসব পড়া সে পড়ে যেখানে এই কথা আছে যে তার দেশ কত বড়ো , কতো গৌরবময় তার অতীত , কত কষ্ট তার মানুষজনের  ... সেই সব পড়া । সেই ছেলেটির মা বড়ই দুঃখী , ভারি গরীব , রাত্রিবেলায় লণ্ঠনের আলোটুকুই তার সম্বল  । ছেলেটির নাম করুণ ।
করুণ তো তার মাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে মা , আমরা স্বাধীন ? মা আমরা কি স্বাধীন ? মা বলেন হ্যাঁ বাবা । একদিন আমাদের এই দেশ ছিল কিছু অত্যাচারীদের দখলে , এখন আমরা স্বাধীন । করুণ বলে ,মা স্বাধীনতা কাকে বলে ? মা বলেন , যেখানে সবাই রাজা হয় । সবাই সবার কথা শোনে । যেখানে একটা দেশ চালায় সাধারনেরা । বরুন জিজ্ঞেস করে , সাধারণ কারা ? এই আমরা বাবা আমরাই সাধারণ । আমরা কেন সাধারণ মা ? এইসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে মা বলত বড়ো হও সব বুঝতে পারবে ।
করুণ যখন তেপান্তরের মাঠে এসে দাঁড়াত , মাঠ যেন তাকে কিছু বলতে চাইত । করুণ যখন নদীর সামনে এসে দাঁড়াত , নদীও যেন কিছু বলতে চাইত , আকাশের দিকে মুখে উঁচু করে দিলে সেও যেন কিছু বলতে চাইত তাকে । করুণ সেইসব কথা কিছু বুঝতে পারতো না । সে বাঁশপাতার পতন দেখত একমনে ...কীভাবে পাতাটা ঘুরে ঘুরে পড়ছে মাটিতে , দেখে বিস্মিত হত করুণ । বিস্মিত হতে হতে সে বড় হয়ে গেল একদিন । সে এখন পাকা রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে কলেজ যায় লাইব্রেরি যায় , পড়াশোনা করে ... কয়েকজনকে পড়ায় , মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয় , মা-কে বলে আর কিছুদিন মা আর কিছুদিন ...
একদিন নদীর সামনে সে এসে দাঁড়িয়েছে , হঠাৎ শুনল একটা ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না ; চারপাশে দেখল কিন্তু নাহ কেউ কোত্থাও নেই ... কে কাঁদছে তাহলে ... সে ভাবতে লাগলো । তেপান্তরের মাঠের সামনে দাঁড়িয়েও একই রকম হল একদিন । মনে হল কেউ যেন কাঁদছে । সে বললো
কে ওখানে ?
কেউ বললো , আমি তেপান্তর
কাঁদছ কেন ?
আমার বড়ো কষ্ট ।  
কেউ বললো ,আমি নদী
কাঁদছ কেন ?
কেউ বলল আমি মাটি
কাঁদছ কেন ?
বিক্রি হয়ে যাচ্ছি আমি
সমবেত কান্নার আওয়াজ এইবার শুনতে পেল সে । আকাশ মাটি নদী কাঁদছে । বলছে শোনো ভাই আমাদের বাঁচাও , অন্তত একটা ব্যবস্থা তো করো ।করুণকুমার ভাবলো এই দেশে এইসব কী করে চলতে পারে । আর তাছাড়া আমরা তো স্বাধীন । এই না ভেবে সে ঠিক করলে সেই দেশের মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে সে । তার মা বলল যাস না খোকা , ওদের অনেক ক্ষমতা , ফিরে আয় । করুনকুমার বলল দেখো না কী করি । সে জিজ্ঞেস করলো নদীকে- কে বিক্রি করে দিচ্ছে তোমাকে । সে জিজ্ঞেস করলো মাটিকে কে তোমায় বিক্রি করছে । জবাব এলো এই দেশ । তখন তার মনে প্রশ্ন এলো এই দেশ যে চালায় আসলে সে তো সাধারণ মানুষের ভৃত্য , তাহলে নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে কথা বলে এর কোনও সমাধান হতে পারে ।
            এই না ভেবে করুণকুমার চলল তার সেই রাজ্যের রাজধানীর উদ্দেশ্যে । সেখানে বিরাট বিরাট প্রাসাদ , অট্টালিকা , বড় বড় রাস্তা , এসব দেখেই তার চোখ ধাধিয়ে গেল ।সেইদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেখা করতে চায় । আবেদন করে যায় সে । দেখা করার অনুমতি পায় না । একজন রাজকর্মচারীকে দেখে সে কিছু বলতে গেল , দেখল সেই কর্মচারী আগে থেকেই সবকিছু জানে । তাকে দেখেই রাজকর্মচারীটি বলে উঠল নদী বিক্রি আকাশ বিক্রি ? আরে শোনো বাপু মন্ত্রীর এইসব বাজে কাজে মন দেয়ার সময় নাই ।
কারোর সঙ্গেই তার দেখা হল না । কাউকেই সে বলতে পারল না নদী আর আকাশের কষ্টের কথা । তার যে-কটা মোহর ছিল সঞ্চয়ে সেটুকুও গেল শেষ হয়ে । বড় বিপদে পড়ে গেল সে ।  শুধু অস্ফুটে বলল কিন্তু আমরা তো স্বাধীন কিন্তু আমরা তো স্বাধীন । তার পাশে একজন ভিক্ষুক ফিক করে হেসে বলল আরে যুবক উহারাও তো স্বাধীন । করুণকুমার বলল , কাহারা ? ওই যে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী রক্ষামন্ত্রী এঁরা !
            কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল করুণকুমারের । সে আবার ফিরে এলো তার গ্রামে । পাতার জনপদে । যেখানে সে নদীর সঙ্গে কথা বলে , গাছের সঙ্গে , আকাশের সঙ্গে কথা বলে , সেখানে সে ফিরে এলো । তাকে পেয়ে তার মা তো যারপরনাই খুশি , কেঁদে ভাসিয়ে দিল তার মা । করুণকুমার সেদিন অপরাহ্নে খুব বিষণ্ণ হয়েই থাকল ।
            সেদিন রাত্রের অন্ধকারে কিন্তু কয়েকজন ঘাতক চুপিসারে প্রবেশ করলো তাদের গ্রামে । তারা দীর্ঘদেহী , কালো রঙ তাদের পোশাকের , হাতে অস্ত্রশস্ত্র । তারা করুণকুমারের শয্যার পাশে দাঁড়ালো আর নীরবে হত্যা করলো করুণকুমারকে । এইবার করুণকুমার সত্যিকারের বড় হল । আর বুঝতে পারল সে কেন সাধারণ । মৃত্যুর আগে তার ঠোঁটদুটো শুধু একবার নড়ে উঠে বলেছিল , কিন্তু আমরা তো ...
            করুণকুমারের গা থেকে সেই রক্ত বেড়িয়ে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত জনপদে , সূর্যোদয় লাল হয়ে উঠলো , রক্তরঙা গা নিয়ে বেড়িয়ে এলো হাজার হাজার মানুষ যাদের মুখে শুধু একটাই আওয়াজ , স্বাধীনতা স্বাধীনতা ...

তিন .  
আমি যদি সত্যি কোনও প্রতিবাদ করে থাকি তাহলে তোমাকে ভুলব না করুণকুমার  , আমি যদি কোনোদিন নদীর সঙ্গে গাছের সঙ্গে আর আকাশের সঙ্গে কথা বলতে পারি তাহলে তোমাকে কথা দিচ্ছি মা আমি কখনও এমন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে যাবো না , আমি যদি কোনোদিন গ্রিসদেশের প্রজাতন্ত্র পড়ে থাকি তাহলে কোনদিনও ভুলব না কীভাবে একটা রূপকথার চক্রান্ত করে তৈরি হয়েছিল আমাদের এই দেশের দায়সারা গণতন্ত্র ...

আমি নিজে তো রূপকথা হয়ে উঠতে পারিনি শুধু ভুলে যাইনি বরুণকুমার-কে ।একটি রূপকথার নাম বরুন বিশ্বাস ।



অমিত সরকার- মৃত শুঁয়োপোকাদের এপিটাফ






ধরা যাক, সেদিনও এমনই রাত, এই ঋতুবদলের মাস। বরানগরের গলি, বন্ধুর সঙ্গে ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে কুয়াশার হিম মাখা চা ও বেকারি বিস্কুট। একজন বৃদ্ধ/ প্রৌঢ়/সিনিয়র সিটিজেন এসে পাশের বেঞ্চে চুপ করে বসলেন। এই  বিশেষণগুলোর একটা শব্দকৌলীন্য আছে, যা আমাদের কনভেনশনাল চিন্তাভাবনাকে একরকম   স্ট্রেটলাইন মান্যতা দেয়, ঘাড় ধরে শেখায় সম্মান  করতে। বন্ধু আমার পিঠে হাত রেখে, ফিসফিসিয়ে, ‘চিনতে পারছিস। বাদলদা। বাদল সেন।’ তারপর সরাসরি দোকানীকে, ’এই, বাদলদাকেও একটা চা, খাবেন তো বাদলদা।’ বৃদ্ধ কিছু বলেন না। যেন এই সম্মাননাটা একান্তই প্রাপ্য ছিল তাঁর, অথবা করদ রাজার থেকে যেন  উপেক্ষায় নজরানা  নিচ্ছেন বৃদ্ধ সম্রাট, এভাবেই তাকিয়ে থাকেন  শূন্যের দিকে। “বাদল সেন” শুনেও আমার কিছু মনে পড়ে না, কোন কিচ্ছু। গিগাবাইট গিগাবাইট  স্মৃতির ড্রয়ারে খেলা করে হা হা আকাশ। ফেসবুকে, ইন্টারনেটে কোন এন্ট্রি নেই। আমার বন্ধুবৃত্তের প্রোফাইলে এই ছবি নেই শুধু নয়, তিনি  সেখানে বেমানান, অদ্ভুত। যেন হগওয়ার্টস স্কুল থেকে নির্বাসিত ভোল্ডেমর্ট। কেউ তাঁর নাম নেয় না। এরমধ্যে চা শেষ হতে বন্ধু তাঁর দিকে এগিয়ে দেয় নিজস্ব প্যাকেটের সিল্ককাট । দু আঙুলে গ্রহন করেন, কিন্তু তাকিয়ে স্বীকৃতিও দেন না।  নিজেই  জ্বালিয়ে নেন একটা পুরনো লাইটারে। তারপর একবুক ধোঁয়া ছেড়ে উঠে পড়েন। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে  যায় ধুসর পায়জামা,  ময়লা রংচটা পাঞ্জাবী। আমি ও বন্ধুর কথামুখ ঘুরে যায় আমাদের একদম ছোটবেলার  সেই  সত্তর,  সেই আগুনঝরা দশকের দিকে আমাদের গল্পের ও  মাথার মধ্যে ঘোরে একটা অলৌকিক মিছিলের কথা।  গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কথা।  চারু মজুমদার, কানু  সান্যাল, জঙ্গল  সাঁওতালের কথা। প্রেসিডেন্সীতে খুন হওয়া কবি দ্রোণাচার্য ঘোষের কথা বাদল সেনের কথা। রুনু গুহনিয়োগীর কথা। যেসব রূপকথা ও শুনেছিল একদিন এই  মানুষটির সাহচর্যে।  আমি অন্য কারুর কাছে। আমার আগ্রহ বাড়ে। বন্ধু হাসে, বলে,  ‘একটা জিনিস দেখবি ?’ আমরা উঠে হাঁটতে শুরু করি। দেখি  কাছেই গঙ্গার ধারে শনিমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে  বাদল সেন প্রণাম করছেন। আমিও ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসি।
আবার অন্য কোন দিন রাস্তায় আমার সঙ্গে ওনার দেখা হয় কখনো আর একটি মন্দিরের সামনে প্রণাম করছেন।  আবার কখনো  মসজিদের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আমার আর সহ্য হয় না। আমার ব্যক্তিগত রূপকথা টুকরো টুকরো  কাচের  বাসন হয়ে ভাঙতে থাকে। এক সন্ধ্যায় আমি ওনাকে চা অফার করি। সিগারেটও। এবং যেহেতু আমার কোন  নিজস্ব দায়ভার বা স্মৃতিদাগ নেই, স্পষ্ট উচ্চারণে প্রশ্ন করি, ‘আপনার কেসটা কি বলুন তো ?  আপনি কী রেনিগেড না সেকুলার  কোনটা হবার চেষ্টা  করছেন এখন ? নাকি আপনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত  একজন বিলিভার ? যে ঠাকুর যেভাবে  দাগিয়ে   দেবে, তাদের সবাইয়ের  জন্য খানিক খানিক ফুল চড়ানো একটা সুবিধেবাদী অ্যাপ্রোচ ? আপনার কেসটা কি, ঠিক করে  বলুন তো কমরেড ?’
বৃদ্ধ হাসেন,  সময়কে ভয় পাওয়া হাসি। বলেন, ‘কমরেড‌ ? আমি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছি । জানি এটা ঠিক নয়, আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। তবু ভুগছি। সততা আর বিশ্বাস হারাতে হারাতে, ভয় পেতে  পেতে আমার চিন্তার ডিসঅর্ডার হয়ে গেছে। আমার সময়টার তো শুধু হেরে যাবার গল্প। সাফল্যের তো কোন  ইতিহাস নেই। তবে আর একটা কথাও বলি কমরেড, তোমাদের পুরো সময়টাও কিন্তু ওসিডিতে ভুগছে। বিশ্বাসহীনতা, প্রত্যয়হীনতার ওসিডি। প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন, সবাইয়েরই আজ চিকিৎসা প্রয়োজন।’  
‘হ্যাঁ, বিশ্বাস নেই বলেই তো টিভি সিরিয়াল থেকে রাজনীতি, সবাইকেই আজকাল ধর্ম বিক্রি করে খেতে হচ্ছে।  ভারতবর্ষের গান্ডু মার্কেটে এইটাই  তো এখন একমাত্র টপ সেলিং প্রোডাক্ট।’  দুজনের ব্যক্তিগত পরিচয়ের  দেওয়ালে সেরকম পুরনো গুলির দাগ নেই।  তবু বলতে থাকি, ‘ঋত্বিকের মত করে তো বলতেও পারতেন, আমি কনফিউসড। তারপরে দেবতার কাছে, অথবা   আলিমুদ্দিনে, অথবা নবান্নে বা অন্য কোথাও কপাল ঠুকে প্রার্থনা জানাতে কে আপত্তি করেছিল ? ও হ্যাঁ, গেরুয়াটাও পরে  দেখলে একবার খারাপ হত কী ? এই লাইনে তো আজকাল অনেকেই খেলছে। কাকাও তো গত ম্যাচে নীলসাদা জার্সি পরে খেলে দিল।’     
‘কি জানি কমরেড। কনফিউসন আছে না নেই ? সেটাও ঠিক করে বুঝতে পারি না আজকাল। “অ্যান্টি ডুরিঙে” কি লেখা ছিল এরকম কথা ? এই অ্যান্টিথিসিস। আর সেরকম প্রার্থনাও আজ অবধি কিছু জানাতে পারলাম কী ? বোধহয়  পুরোটাই আমার বা  আমাদের একটা ওসিডি ম্যানিয়া।’          
‘তাহলে, সাতই নভেম্বর অরোরা জাহাজে মাঝরাতে যে ঘোষণাটা হয়েছিল, অথবা লং মার্চ, যাদের নিয়ে আপনাদের  এতো সব ফ্যান্টাসাইজিং, সেইসব স্বপ্নদিনের টুকরো টাকরা তো আপনারা একদিন জমিয়ে  রেখেছিলেন বুকের গভীরে। একসময় চালানও করেছিলেন আমাদের কারু কারুর বুকে। তাতে মরচে ধরে ক্ষয় লেগে, সেই মালটা এখন এক্কেবারে  উবে গেছে। খতম। আর সাতষট্টির পঁচিশে মে’র এসপ্ল্যানেডে সেই রূপকথার মিছিল। সে গল্পটাও শেষ।  বাকিটুকু কাবাড়িওয়ালার কাছে  বেচে  দিয়ে একদম ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর, ...।’ আপনাদের গল্পটা তো এইটুকুই?’
‘কেন সমস্ত রূপকথা খুব দ্রুত ভেঙে গেল ? এই প্রশ্নটার উত্তর আমার কাছেও ঠিকঠাক স্পষ্ট নয় কমরেড। তবে...’
‘তবে মানে ? আপনারই তো বলতেন, “ইতিহাসের দুটো নাম/ নকশালবাড়ি, ভিয়েতনাম।” আপনাদের অভিমুখহীন খতম থিয়োরি, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার রূপকথা সব ফালতু। একদম রাজারানী, রাক্কস খোক্কসের ছেলেভুলোনো গল্প। শালা আজকাল ভিয়েতনামে ট্রাম্প বউ নিয়ে বেড়াতে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, অন্তত  একটা চতুর নাগরালি দলের চুতিয়ামি থেকে আপনারা মুক্ত থাকবেনআপনাদের স্ট্যান্ড থাকবে, গ্রামে চলো।  হাতে লেগে থাকবে  মাটির দাগ,   ময়লা পাঞ্জাবীতে শ্রমের গন্ধওরা এতো, আমরা  এতোর অহংকারী মূর্খতা নয়,  হাত ধরে টেনে তোলার সমবেদনা। মাঝখান থেকে তারাই চৌঁতিরিশ বছর মধু খেয়ে গেল। আর আপনারা ? এ লাইন থেকে ও লাইনে এক ইঞ্চির সরে যাওয়া নিয়ে তত্ত্ব মারালেন। আপনাদের কী অবস্থান ছিল   মরিচঝাঁপিতে ?  সিঙ্গুরে, নন্দিগ্রামে, ভাঙড়ে কি ছিঁড়লেন আপনারা ? মাঝখান থেকে একটা বিশ্বাস, একটা স্বপ্নের মৃত্যু হল। শুঁয়োপোকাগুলো সবাই সব্বাই মরে গেল। একজনও প্রজাপতি হল না। সব শালা দালাল আর  সুবিধেবাদী। বাল, একটা রূপকথা তো ছিল কারুর কারুর। জানি, বুঝি, সেসব সত্যি হত না কখনো, কিন্তু ছিল  তো  আপনাদের  মত বুড়ো ভামেরাই আমাদের ছোটবেলার রূপকথাগুলোকে ভেঙে দেবার জন্যে  দায়ী। যদি ভেঙেই দেবেন, টিকিয়ে রাখতে পারবেন না, তবে কেন লিখেছিলেন রূপকথাদের ? বলতে পারেন কেন একটা  স্বপ্নের সিস্টেম, একটা গোটা রিপাবলিক, একশো  বছরেরও কম সময়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ? আর যেখানে সিস্টেম টিকে থাকবে, সেখানে সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে  আমৃত্যু এক  রাজা, যার  মুখের কথাই আইন। একবারও ভেবেছেন, আপনার সন্তানেরা, তাদের সন্তানেরা কী স্বপ্ন  বুকে নিয়ে বাঁচবে  এরপর ?’ আমার ঠোঁট কাঁপছে আমি বুঝতে পারি। বৃদ্ধ আমার হাতে হাত রাখেন। ঠাণ্ডা কুঁচকনো হাতেও সামান্য উষ্ণতা এখনো লেগে। আমার হাত ধরে টানেন, বলেন, ‘চলো কমরেড, তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই’    
আমরা দুজনে অন্ধকার বরানগরের গলি ধরে ধরে হাঁটতে থাকি। আমার মনে পড়ে, একদিনে তিনশো তরুণকে গুলি করে মেরেছিল পুলিশ এই সব গলিতে শুধু একটা রূপকথা বিশ্বাস করার অপরাধে। খানিকটা  হাঁটার পর আমরা পৌঁছই আর  একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে। দেওয়াল দেখে বোঝা যাচ্ছে বহুদিন সংস্কার হয় নি। হয়ত মালিকেরা আর কেউ  বেঁচে নেই,  আর এই গলির গভীর জঙ্গলে প্রমোটারেরও নজর পড়েনি। ভেতরে একটা নাইট স্কুল। কয়েকটা বস্তির ছেলেকে পড়াচ্ছে  দুজন  তরুণ ও তরুণী। বৃদ্ধ কিন্তু ভেতরে না ঢুকে আমাকে নিয়ে বাইরের দেওয়ালে কি যেন দেখাতে চান। মৃত বাল্বের আবছা অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে রেখেছে, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। বৃদ্ধ লাইটার জ্বালেন। দেখি দেওয়ালে পঞ্চাশ বছরেরও আগে  স্টেনসিলে আঁকা রংচটা ছবিতে বিরাট দাড়িওয়ালা মুখ নির্নিমেষ চেয়ে আছে, পাশে টেকো ফ্রেঞ্চকাট স্বপ্ন ফেরী করা রাশিয়ান, আরও কেউ  কেউ একদম আবছা। বৃদ্ধ ততক্ষণে নিজের পাঞ্জাবী দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছেন দেওয়ালে লেখা একটি  পুরাতাত্ত্বিক শ্লোগান,  “মেহনতি  মানুষ, ধরো বই। ওটা  হাতিয়ার।” আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হয়তো এভাবেই রূপকথারা বেঁচে থাকে, গোপনে                                  

বুদ্ধদেব বসুর ব্যদলেয়ের-- অর্জুনদেব সেনশর্মা







এডগ্যার এলান পো,যিনি কিনা,ব্যদলেয়েরের আগেই একটি নতুন কাব্যাদর্শের সন্ধান করছিলেন,তাঁর নিজের কাব্যভাবনাটি কীরকম ছিল?সাহিত্যের মোটাদাগ সমালোচনায় আমরা সহজেই বলে ফেলতে পারি,তিনি রোমাণ্টিক কাব্যপ্রতীতির মধ্যে গ্রোটেস্ককে বপন করে দিলেন।এ এমন কিছু নতুন ব্যাপার নয়।নতুন লাগে মাত্র,কারণ,রোমাণ্টিকতাকেও আমরা স্বরূপে বুঝতে খুব অভ্যস্ত নই।রোমাণ্টিকতা একটা চিত্তবিস্ফারের অবস্থামাত্র।তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে,যেগুলি তাকে ক্লাসিক শিল্প থেকে আলাদা করেছে।তা নয়তো,হয়তো চিত্তবিস্ফার বাদ দিয়ে কবিতা লেখাই সম্ভব নয়,এরকমও কোনো আচার্য ভেবেছেন।
আমি যথাসম্ভব কম জটিলতার মধ্য দিয়ে যদি বলি,তাহলে বলতে হয়,রোমাণ্টিক কবির যে ধরনের চিত্তবিস্ফার ঘটে,তার মধ্যে যদি একটি অভ্যাস হয়,নিয়ত মঙ্গলময় অমিতায়ু শুভর মধ্যে বিলীয়মানতা,তবে রোমাণ্টিক চিত্তবিস্ফারেরই আরেকটি ধরন হতে পারে,নিয়ত আত্মক্ষয়ের মধ্যে অমঙ্গলময় শূন্যতার অঘোরপন্থা।বস্তুতপক্ষে এও বিব্লিকাল এবং পোলেমিকাল আলটিমেট।কীটসের ধারাটিই এইরকম।
পো এই ভাবের কবি।ভারতীয় দৃষ্টিতে তাকে বলব,শুদ্ধবীভৎস বা ভয়ংকর বা নির্বেদসঞ্চারিত শম এর নানা বিন্যাস।ব্যদলেয়ের পোর থেকে এই উত্তরাধিকার পেয়ে কাজ চালিয়েছেন বললে,তাঁর জীবনকে সীমিত করা হয়,য়ুরোপের দীর্ঘলালিত একটি প্রত্নপ্রতিমাগুচ্ছকে অস্বীকার করা হয় এবং য়ুরোপের সমকালকেও ভুলবোঝা থাকে।ব্যদলেয়ের নিজের জীবনের স্বাভাবিক গতিতে এই দ্বিতীয় দলের কবি।অভিজ্ঞ এবং উত্তরাধিকারী-দুইই।

বুদ্ধদেব,ব্যদলেয়েরের এই ধরনকে স্পষ্ট অল্পকথায় চিহ্নিত করতে পেরেছেন কিনা জানিনা,এক আধবার বলেছেন বটে,তিনি আবেগবর্জিত উপলব্ধিসার আধুনিক কবি।আধুনিকতার এই লক্ষণ, যদিচ এলিয়টসম্মত বটে,তথাপি,রোম্যাণ্টিক বা প্রথমশ্রেণির রোম্যাণ্টিকরা আবেগিক মাত্র,এইজাতীয় একটা সরলীকরণ,তাঁর ব্যদলেয়ের-ভূমিকার প্রথম দুর্বলতা।আবেগ কবিতার মেরুদণ্ড কিনা,আবেগ আর উপলব্ধির কগনিটিভ ভেদ কী,আবেগ শুধু ইগো ও উপলব্ধি অধিশাস্তা কিনা,অধিশাস্তা কবিতা লিখতে পারে কিনা,আসলে উপলব্ধি বলতে এলিয়টই গোড়াতে গলদ করেছেন কিনা,এসব তর্কে আর যাচ্ছিনা।(শঙখ ঘোষ কিন্তু এলিয়টীয় কিছু সিদ্ধান্তকে অনেকদিন আগেই যথার্থ প্রশ্ন করেছিলেন।অন্তত আবেগ ও প্রেরণা বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য।)
আবেগ একটা উন্মাদনাজাত ক্রিয়া,কবিতা সেই ক্রিয়ারূপ হয়ে গেলে কবিতার সর্বনাশ হয়,কবিতার জন্য,আবেগের অবস্থান যে ইগো,সেখান থেকে একটু একটু করে নির্জ্ঞানের দিকে নেমে আসতে হয়,এইটুকুই মনোবিজ্ঞান-অনভিজ্ঞ এলিয়ট বলতে চেয়েও বুঝিয়ে বলতে পারেন নি,তা বুদ্ধদেব না বুঝেই উঠতে পারেন,কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ তা নিশ্চয় বুঝেছিলেন।যদি না বুঝতেন,তাহলে 'ঐতিহ্য ও টি এস এলিয়ট ' প্রবন্ধে তিনি এলিয়টের এক্সটেন্সান ইয়ুং দিয়ে করতেন না।

বুদ্ধদেব নিরাবেগ রোমাণ্টিকতার উত্তম ফল বলে,ব্যদলেয়েরকে চিহ্নিত করলেন।কী দেখে?কবিতার ফর্ম,সংক্ষেপপ্রবণতা,কয়েকবার গ্রোটেস্কের চিত্রকল্প দেখে।তিনি বুঝলেন না,প্রতিটি সৃষ্টির পশ্চাতের ইমপালস আবশ্যিক।মহৎকবি সেই ইমপালসকে যথার্থ ভাষা দিতে দিতে,ইমপালসকে ক্ষয়িয়ে ফেলেন।কবিতা শেষ হয়।এখন আত্মক্ষয়ী ঐ দ্বিতীয় শ্রেণির বিশেষ রোম্যাণ্টিক কবিদের ক্ষেত্রে,যা হয়,তা হল এই যে-বীভৎসের ইমপালস বা আবেগ সাধারণত স্বভাবত ক্ষণকালীন হয়।কারণ মনোচিকিৎসাতত্ত্বের মতে,মানুষের মন যদি,চলে ফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে থাকতে চায়,তবে বীভৎসা,ভয়,নির্বেদের মধ্যে অধিকসময় নিজেই থাকতে পারেনা।সে বেরোতে চায়।সেই ক্ষণজীবী নরকের সুন্দরতর কবিতা ব্যদলেয়েরের হতেই পারে,তার মানে এই নয় যে,সেযুগেই এই দ্বিতীয় শ্রেণির কবিদের এই ভাবোন্মাদ দীর্ঘস্থায়ী মহৎ কবিতা দেবে না।ব্যদলেয়েরের ভাঙনের চিত্রকল্পগুলি,আসলে বদ্ধ-আবেগের প্রলাপিত,ক্ষুদ্র অথচ অলোকসামান্য সৃষ্টি নয়,তাইই বা বুদ্ধদেব কী করে বুঝলেন?'ভাব'উপচীয়মান না হলে,কবিতা লেখা কীভাবে সম্ভব?তাহলে,স্পিনোজা কবি এবং গ্যথে দার্শনিক হলেন না কেন?মহাপ্রভু কেন রঘুনাথ হলেন না,রঘুনাথ কেন মহাপ্রভু হলেন না?

এমনকী এই ইম্পালসিভ ট্রান্স যে রোমাণ্টিকদের প্রথম দলের মতই দ্বিতীয়দলের পররোমাণ্টিকদেরও দীর্ঘ কবিতা লিখিয়ে নিতে পারে,এলিয়ট নিজে তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।আমরা এই দ্বিতীয় ধরনের হ্রস্ব/দীর্ঘ ভেদ নিয়ে এখনই বিস্তারে যাচ্ছিনা,কিন্তু বুদ্ধদেব ব্যদলেয়েরের একটি চিত্রকল্পেরও ক্ষয়িষ্ণু অসংলগ্নতার মূল বিচার না করেই তাঁকে উত্তর-রোমাণ্টিক আধুনিকতার একমাত্র বিগ্রহ বলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলছেন।তা অংশত সত্য,কিন্তু হবালটার বেঞ্জামিন যে অমোঘ বিশেষণে,ব্যদলেয়েরকে বিশ্লেষণী যুগের উচচতম "লিরিকাল পোয়েট"বলেন,তা বুদ্ধদেব ধরেও ধরতে পারেন না।অথবা তিনি লিরিক বলতেই অদৃশ্য এক মহাকবির বীণাবাদিনীর জালে ধরা পড়ে যান।সুরান্তর মানেই,যে সুরহীন নয়,সেই রসবোধ থেকে বুদ্ধদেব স্খলিত হন।

অতঃপর বুদ্ধদেব,আবেগ-নিরাবেগের মধ্যে দুলতে দুলতে, আবেগমন্দ্র উচ্চারণে,আধুনিকোত্তম এবং নাকি ব্যদলেয়েরীয় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন,আধুনিক কবির লক্ষণ উদ্দ্যেশ্যহীন উৎকেন্দ্রিকতা।তাঁর ভূমিকা-প্রবন্ধের এই স্থানে এসে সচকিতে ভাবি,এমন কোন সে কবি আছে,যে উৎকেন্দ্রিক নয়?
রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রিক?তিনি তো কোন শৈশব থেকে ইস্কুল ছেড়ে,জাহাজ পালিয়ে,বিলেত ছেড়ে জীবনটাকে অনির্দেশ্য করে ফেলেছিলেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রথম জীবন?কীটস,শেলি,বায়রন,কে সে,কোন সে রোমাণ্টিক কবি যিনি পথ ছাড়েননি?কার জীবন,সহজ আনন্দে কেটে গেল?কবি-নায়কদের জীবনে হাইপেরিয়ন রচিত হতে পারে,মনে হতে পারে কীটস শুধু ঘাসের উপর আহ্লাদে লুটোপুটি খেতে খেতে দেবদূতের মত স্বর্গে চলে গেলেন,কিন্তু আপনারাই কি মানতে প্রস্তুত আছেন,তা?
কবিতা মিথ্যে বলে না,কবিতা সত্যও বলে না।কবিতা অনেকসময়েই বিপরীতকে বলে।রবীন্দ্রনাথকে মোহিনীমায়ার মত প্রতারক বলেও,বুদ্ধদেব বিচারের সময় এ কী বললেন!

কেন,বুদ্ধদেবকে উৎকেন্দ্রিক বলতে হবে?বুদ্ধদেব দেখাবেন,আধুনিক কবিদের যাত্রা আছে লক্ষ্য নেই,এবং প্রতিপক্ষ অবশ্যই পথ রুধি রবীন্দ্রনাথ,তাঁর কিনা পথ আছে এবং লক্ষ্যও আছে।

বুদ্ধদেব যে ব্যদলেয়েরকে পেয়ে,রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় কবি পাওয়া গেল,ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন,সেই বুদ্ধদেবই কি রিলকের অনুবাদ করেছিলেন?যদি করেন,করজোড়ে চলে যাওয়াই কর্তব্য,তবু,ট্রান্সেণ্ডেণ্টাল সিম্বলিস্টদের বুদ্ধদেব কীভাবে পড়লেন?এমনকী ব্যদলেয়ের যে বিধ্বংসী আর্টের ক্ষীয়মান আবাসে (না প্রতীক নয়) চিত্রকল্প তৈরি করছেন,তা নিয়তভঙ্গুর হলেও নিয়তলক্ষ্য।রিলকের ঈশ্বর ছিল না?ঈশ্বরের বোধ বা শয়তানের মহিমময় সিংহাসন,যাই তিনি রচনা করুন,তাইই লক্ষ্য।র‍্যাঁবোর নৌকোর লক্ষ্য কোনদিকে?লক্ষ্যহীন কে?সুধীন্দ্রনাথ?না।জীবনানন্দ?নিশ্চয় না।বিষ্ণু দে?হাসব না কাঁদব?
বিশুদ্ধ অবক্ষয়ের নিরালম্ব কবিকে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিতে হয়।বুদ্ধদেবের সময়ে সমর সেন তখনো ফুটে ওঠেন নি।এবং তাঁর মৌনতা তখনো অনেক দূর।ভাষার বাচকশক্তি যতদিন তিলমাত্রও অনুভূত হবে,ততদিন যেকোনো ভাষিক-কৃতির লক্ষ্য থাকবেই।এই সীমাবোধই তো সিম্বলিস্ট কবিদের অর্জিত শিক্ষা।তাঁরা পারেননি বলেই তো,তাঁরা ব্যর্থ অথচ মহৎ।বুদ্ধদেব,একটি আউড়ে যাওয়া শব্দ আউড়ে গেলেন,কিন্তু শিখতে পারলেন না।তাই অনুবাদক হিসেবেও বোধয় তিনি ব্যদলেয়েরকে ছুঁতে পারেননি।যদিও তা অন্যরা বলেন।আমি ততটা নিশ্চিত নই।
বিপরীতে ব্যদলেয়েরের এই স্বোদ্ভাবিত অলক্ষ্য স্বভাব লক্ষ করে,বুদ্ধদেব লিখলেন,রবীন্দ্রনাথের পথ, কবির আজীবনের পথের মোটিফ,রুদ্ধগৃহ-পথপ্রান্তে থেকে অবঞ্চিত-সত্যের তুচ্ছতায় বিকীর্ণ হতে হতেও নাকি লক্ষ্যমাত্রায় সীমিত।
যে কবি নিজের মৃত্যুর গান,মহা-অজানায় শেষ করে দেন,তাঁকে কেন্দ্রিক জীবনের স্থিতধী কবি বলে ঔপনিষদিক ব্রহ্মের লক্ষ্যে অবিচল দেখালেও বুদ্ধদেবের এই আধুনিক উৎকেন্দ্রিক লক্ষ্যহীন কবি-প্রকল্প তখনই ভেঙে যাবে,যখনই আমরা বুদ্ধদেব-উত্তর কবিসমাজে হাংরির পাশে গোষ্ঠীগত কৃত্তিবাসকে রাখবো,রাখবো সত্তরের অধিকাংশ কবিকে।রাখবো শঙখ ঘোষকে,রাখবো অলোকরঞ্জনকে,রাখবো সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে,মণীন্দ্র গুপ্তকে।

বুদ্ধদেব বাহ্য-কবিজীবন,অন্তর্কবিজীবনের ভেদ বুঝতেন না,তাই অহেতুক বাইনারি দিয়ে আধুনিক কবিতার লক্ষণ চিহ্নিত করতে গিয়েছিলেন।

আসলে ব্যদলেয়ের পেয়ে,তিনি রবি-ঋণ থেকে উদ্ধার পেলেন,ভেবেছিলেন।ভূমিকা-প্রবন্ধ গোটাটাই আমার পাঠে,ব্যদলেয়েরের উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের উত্তরপক্ষ।

কেন বুদ্ধদেবের এই বিভ্রম?
বুদ্ধদেব সামান্য ব্যক্তি ছিলেন না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন রমরমা।বুদ্ধদেব সপারিষদ উজ্জ্বল ছাত্র।বুদ্ধদেবের ক্যাম্পাসজীবন পঠন-অভিজ্ঞতায় পূর্ণ।কবিতাপাঠক বুদ্ধদেব ইউরোপের কবিতা পড়ছেন।বয়স তরুণ।দিব্য-এরস তাঁকে প্রণোদিত করছে নিয়ত।বুদ্ধদেব গোগ্রাসে পড়ছেন কণ্টিনেণ্টাল।এবং বুদ্ধদেবের প্রবন্ধ অনুসরণ করলে,দেখবেন একইসঙ্গে ভারতীয় সাহিত্যও পড়ছেন।তাঁর উচ্ছ্বসিত পাঠ - অভ্যাসের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা পূর্ণ আবিষ্ট কবি-পাঠকের।আদর্শ রোমাণ্টিক পাঠক,তিনি।তাঁরা সাধারণত আদর্শ বিশ্লেষক নন।
এবার একটু স্মরণ করুন,বুদ্ধদেবের কবিতা,কাব্যনাট্য,উপন্যাস।কোথায় বুদ্ধদেব লক্ষ্যহীন?বিধ্বংসী মৃত্যুর পিশাচনৃত্যের বিচূর্ণ দর্শক হিসেবে,মাইকেলের মত কোনো নরকযাত্রার বিবরণ,যা তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত বলে মনে হতে পারে,তাও তিনি দেননি বিশেষ।আমরা যে হ্রস্ব  ডার্ক-রোমাণ্টিক কবিতা বলে প্রস্তাব করতেও পারি,এমন কোনো পিনদ্ধ কবিতা বুদ্ধদেবের,এখুনি মনে আসে না।উপরন্তু কীটসের মত পেগান ক্যাসেল রচনা করতে তাঁর জুড়ি নেই।ননতো তিনি নিজে ব্যদলেয়েরের মত তীব্র প্রত্যাহরণপন্থী,বিমর্ষ,উদ্যমহীন,আনখশির মৃত্যুলীন।ননতো তিনি রিলকে বা র‍্যাঁবোর মত অবিতর্কিত উৎকেন্দ্রিক জীবনের যাপক,এবং তাঁর সাহিত্যেও তো সেই ভয়াবহ,বুকহিম করা মৃত্যুঘন নির্বেদ নেই,তবে কী হোলো বুদ্ধদেবের?

বুদ্ধদেবের ইনস্টিংক্টিভ যৌবন,ভারতীয় এবং রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারেই চেনা পথেই উৎসর্জিত হয়ে,কামকে সঞ্চারী হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল এবং দেখেও ছিল।এই শৃঙ্গারের সঞ্চারী কামের বর্ণনাতেও তিনি ডিক্সন অর্থাৎ কবিভাষাতেও এই মর্বিড কবিদের অনুসরণ করতে পারেননি।বা চানও নি।বা পছন্দ করলেও পারেন নি।আসলে তিনি নিজে আদি-দলের রোমাণ্টিক হয়ে,আদি-দলের রোমাণ্টিকদের মতই দ্রোহপ্রবণতার ফলে,এক অসম্ভব তুলনা করে যাচ্ছিলেন।কালোর সঙ্গে বেঁটের তুলনা,যদিও দুজনেই মানুষ।

তাঁর ঐ রোমাণ্টিক মনেরই দ্রোহ-প্রবণতা ও অবশ্যই বিস্মিত, নবীন, সৌন্দর্যবোধ তাঁকে পররোম্যাণ্টিকদের আত্মমগ্ন -আত্মহননেচ্ছাময়, নরকসন্ধানী ও বিচূর্ণ ব্ল্যাক-রোমাণ্টিক প্রতীকগুলির প্রতি তাঁকে, তাঁর কবিস্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি না রেখেও,আকৃষ্টও করতে লাগল।স্বাভাবিকভাবে,যুদ্ধদীর্ণ য়ুরোপে তখন বীভৎস,ভয় শমের দিকে যেতে চাইলে বাণীর রূপকের উপর ভরোসা করবে কম।তৈরি হতে থাকবে ভগ্নপ্রতীক,ভগ্নছন্দ,মন্ত্রোপম কর্কশ অথবা ভয়ংকর ধ্বনিতরঙ্গ।তৈরি হবেই ডার্ক-রোমাণ্টিক/সিম্বলিস্ট, ইমেজিস্ট রহস্যময়তা।বুদ্ধদেব নিজে তো সেইধারার কবি নন।কিন্তু আকৃষ্ট হয়েছেন।নিতে পারেননি।অথচ যে দ্রোহপ্রবণতা,এই ব্যদলেয়েরীয় প্রত্যাহরণের ঠিক আগের স্তরের রোমাণ্টিকদের যে ঐতিহাসিক স্বভাব,সেখেনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে,পরের স্তরের দিকে লুব্ধ হলেন।নিজে এগোলেন না বলে ভাবলেন,রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই তা পারতে পারেন না।জন্ম তাঁর যবেই হোক ১৮৬১তে।কীদেখে, বুদ্ধদেব এই সিদ্ধান্ত নিলেন?মোহিনী মায়ার মত প্রতারক বলেও,তিনি ভিক্টোরীয় সংস্কারে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে নিয়ে ভেবে ফেললেন,রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবের নিজের কবিপরিধির মতই সীমাবদ্ধ।তুলনা করবার সময়ে রবীন্দ্রনাথের শ্বাসরোধী গানগুলির একটিও তাঁর মনে পড়ে না।কেন?কেন না রোমাণ্টিক বলেই,তাঁর রবীন্দ্রনাথ,তাঁর নিজের মাপে তৈরি।

তিনি ভেবেই নিয়েছেন,বিদেশী নতুন কবিদের যে ইণ্টারপ্রিটেসানে নতুনরা নতুন,সেগুলি কদাপি রবীন্দ্রনাথে থাকতে পারে না।অথচ এ একবারও ভাবছেন না,আধুনিক য়ুরোপ বলে যাদের তিনি ভাবছেন,তাঁরা মানবমস্তিষ্কের ধারণক্ষমতার বহির্দেশে কোনো অলক্ষ্যে উৎসর্জিত হলেন কিনা,সেটা বুঝবার দুটি মাত্র রাস্তা আছে,হয় এসাইলাম নয় স্পিরিচুয়ালিটি।
দুটিতেই বুদ্ধদেবের অধিকার ছিল,শুনিনি।


একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম