ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে...যায়নি
দুটো
ছেলেমেয়ের প্রেমের সম্পর্ক।
তারা কি ভালো
বন্ধু হতে পারে?
উত্তর, না।
আমার জীবনে অন্তত।
আপনি প্রশ্ন
করবেন, কেন? আমি বলতে পারব না। বোকা হেসে বলব, হয় না। তাই। বলতে পারলে আমি নোবেল
পেতাম।
এ প্রশ্নের
উত্তর পেতে রবি ঠাকুরের গান হেল্প করতে পারে। আর কবীরের গান। দুটি মানুষের ভেতরের
সম্পর্কের মানবাত্মার সার ধরা এদের গানে। যেমন কবীর ভালোবাসাকে লিখেছেন, "
আজন্ম সন্ন্যাসী", "শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রাণায়াম", " তুমি কি
বোঝো না কেন সুর আসে বুকে"। কত উদাহরণ দেব। রবি ঠাকুর লিখছেন, "মিলনের
বীজ অংকুর ধরে"। আরো হাজারো লাইন। যেগুলো আগের লেখায় বারবার কোট করেছি। কেউ
কেউ একটা কারটেসি না দিয়েই সেগুলো শেয়ারও করেছেন দেখলাম।
ভালোবাসা কি?
সহজ ভাবে বলা
যায়, যা দুটো মানুষকে এক করে দেয়। বাউলরা বলেন, এক থেকে দুই হয়। আবার দুই থেকে এক।
একাত্মা। একক। যেখানে ব্রহ্মাণ্ড মিলে যায়। বিন্দুতে সিন্ধু।
দুটো মানুষের
সাজপোষাক, তাকানো, গলার আওয়াজ, লেখা গান, বোধ, ছোয়া, ভাবা, শব্দ, সুর, ঘরের আলো,
আসবাব সব এক হয়ে যায়। আলাদা দুটো দেশে থাকলেও হয়। কথা না বলেই বোঝা যায় মেয়েটি
কোথায় আছে এই বিকেলে। কি করছে। স্রেফ ফোনে কথা বলে। একটা না-দেখা সুতো বেধে দেয়।
রবি ঠাকুর একে বলেন, " জানি বন্ধু জানি/ তোমার আছে তো হাত খানি।"
"এই যে তোমার প্রেমের বাণী/ প্রাণে এসেছে"।একে ব্যখ্যা করা যায় না। করলে
সভ্যতা নিভে যাবে।
তবে তার জন্য
এক জনকে আরেক জনের ধারণ করার শক্তি রাখতে হবে। গতি হতে হবে সমান। এবং এটা বানানো
যায় না। হয়।
আর তাই বন্ধু
হতে পারে না প্রেমের সম্পর্কের দুটি ছেলে মেয়ে। কারণ, বন্ধুত্ব নগ্নতা চায় না। চায়
স্বার্থহীন সম্পর্ক। প্রেম খুব ক্রুয়েল। অথবা ডুয়েল। নগ্ন ভাবে মারতে চায়। মেরে
ফেলতে চায়। বাঘের মত। খুব ডিমান্ড করে। এত তার জোর। শক্তি। মনের এই দরজায় সবাই
যেতে পারে না। পুতুল পুতুল বিয়ে করে হিসেব কষে নেয় অনেকে। অনেকে এক বিছানায় শুয়েও
সারাজীবন টের পায় না, প্রাণের মাঝে সুধা আছে। বা, কখন ঘরেতে ভ্রমর এসেছিল,
অন্ধকারে। বা কখনও ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে।
শিল্পী প্রতি
যুগে এই প্রেম দিয়েই একটা দাগ কেটে যান। আর সে দাগে এসে যায় মক্কা-মদিনা। অন্তর
যোগ দিয়ে কাটা এই দাগ জোড়ালো হয়। হয় সাধনার মত পরম। গানে রাখা থাকে এ চিঠি অথবা
বিপ্লবে। শিল্পী এক মেয়ে থেকে তাই চলে যান জন্মভূমিতে। কামনা করেন শহর, উদ্যান,
সান্ধ্যপল্লি, বন্দর। কবীর লেখেন, "সন্ধে হল সন্ধে হল/ এখন ঘরে ফিরছে
যারা/তাদের মনে শান্তি আসুক/শান্তি আনুক সন্ধেতারা"।
সহজীবীদের
জন্য এই এম্প্যথি শিল্পীর চূড়ান্ত অবস্থান। তখন আর একটা মেয়ে নয়। একটা জাতি।
বিশ্ববাসী আমার আত্মার আত্মীয়। সহযাত্রী।
কলেজে আমরা
বলতাম, প্রেম করা যায় না। প্রেম হয়। রবি ঠাকুর লেখেন, "হাত দিয়ে দ্বার খুলবো
না গো/ গান দিয়ে দ্বার খোলাবো..."। ঘটক যুক্তি তক্কে" দেখান অরণ্যে দুই
যুবক যুবতী। নিঃশ্বাস বেড়ে চলেছে তাদের। অলখ্য থেকে এসে পড়ছে অপার আলো। তারপরেই
নৈরাজ্য। কামনায় বিপ্লব। এখানে রবি ঠাকুরও চলে যান। কবীরও। সেটা এ লেখার প্রসঙ্গ
না।
আমার প্রায়
৫০০ ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট জমে। তবু লোকে কে-জানে-কেন আমায় রিকু পাঠায়!
প্রতিদিন
সকালে আমায় নানা বয়সী লোকে সুপ্রভাত জানান। হয়তো অনেককেই জানান।
আমি ভেবে
দেখেছি, এদের কোথাও না কোথাও আমায় দরকার। ইন্টারেস্ট আছে। আর আছে ইন্সিকিওরিটি। যা
এ জাতকে গ্রাস করছে ক্রমশ দ্রুত।
২০০৫ এ এলো
ফেসবুক। ২০১০ এ ওয়াটসএপ। দুনিয়ার সংযোগের ভাষা গেল বদলে। সবার পকেটেই এখন লাখ লাখ
"ফ্রেন্ড" জ্বল-জ্বল করে। প্রত্যহ। স্নোডেনের বিপ্লব সম্ভব ছিল না
ডিজিটাল ছাড়া। ওয়ালস্ট্রিট-ও তাই। জাফার পানাহি প্রবল রাষ্ট্রচাপেও বাড়ি বন্দি হয়ে
ফোনে ছবি তুলছেন। ঘটক থাকলে, আমি বিশ্বাস করি, "সিনেমাকে লাথি মেরে"
কমিউনিকেশনের এই নব্য ভাষাকে স্বাগত জানাতেন।
এটিএম।
সিসিটিভি। ডিজিটাল। আর তার সাথে ফ্রেন্ড উইথ বেনিফিট!
সম্পর্কের
নতুন নাম। মানে, প্রেম করেও ক্লেম করব না। পাছে ছক করে ব্লক হই! ইগো আছে ভাই।
স্পেস চাই। তাই কেস না খাই।
প্রেমের
সাথেই দোসর হয়ে চলে আসে পসেসিভনেস। একটু পসেসিভ না হলে আর কীসের প্রেম! মেয়েটা
অন্য মেয়ের প্রশংসা শুনতে পারে না। মাঝে মাঝে তার সামনে নামটা বলে প্রেমটা ঝালিয়ে
নেওয়া (নিন নারীবাদে রেগে উঠুন!)। এবং ভিসাভি। আমি একে কেন্দ্র করে মাত্রা তিরিক্ত
মারামারির কথা বলছি না। কিন্তু সামান্য জলও যদি রসিয়ে রসিয়ে না ফোটে! ব্রোনো যদি
টিপে টিপে না ফাটে..তবে আর কি হল...
কিন্তু এ সব
আর পরমব্রত রাইমার সাথে আজকের ছবিতে হিন্দুস্তান রোডের লিভ ইন এ করে না। স্পেস
লাগে ভাই! মাঝে মাঝে রাইমা ফোন করে দরকার মত মাঝরাতে " ভালো লাগছে না"
ঘ্যানঘ্যান করে নেবে। বাকি সময় তার স্পেস লাগবে। সাফ কথা। তখন পরমব্রত মনের দুঃখে
গিটার বাজাবে! কারণ তার স্পেস নেই। ফেস আছে, বুকে!
আমাদের সময়ের
এ সব ভণ্ডামি নীচের ছবিতে স্পষ্ট। রবি ঠাকুর যতই লিখুন, যাবার পথে আগিয়ে
দিয়ে...রাঙিয়ে দিয়ে যাও...। কবীর যতই লিখুন, একটি মন আরেকটি মন ছুলে বিস্ফোরণ। বা,
"সাপেরা বধির হয় সাপিনীরা শুধু সুর শোনে.."। গৃহযুদ্ধ ছবির শেষে মমতা
শঙ্কর যতোই তার নকশাল প্রেমিক অঞ্জন দত্তকে রিফিউজ করুন, কেরিয়ারিস্ট হয়েছেন বলে!
যতটুকু দরকার
ততটুকুই। তাই সকালে মেসেজ, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, বন্ধু সেজে সেটুকু হাসিল করেই
উইকেন্ড। তা এমন সময়ে বিজেপি আসবে না তো কে আসবে!
প্রেম নিয়ে
অনেক কথা লিখল। সে প্রেমের আলো এখনো অনলাইন। কিন্তু নীভু। প্রেম বা বিপ্লব বেশিদিন
থাকে না। "যাওয়ার পথে আগিয়ে দিয়ে" তা চলে যায়। বিয়ে আর সরকার আবহমান
প্রতিষ্ঠান। যার সাথে প্রেম বা বিপ্লবের কোনও সম্পর্ক নেই।
মেয়েদের এক
রকমের দেখা থাকে। হ্যা, পুরুষকে দেখা। যখন কামনা আসে। খিদে পায় তাদের। রবি ঠাকুরের
ছবির চোখ যেন-বা। শিকারের আগে হরিণ-চোখ। জ্বলে ওঠে। দপ করে। যেভাবে চতুরঙ্গের
দামিনী দেখে। দেখে, মেঘে ঢাকা তারা-র নীতা। জানলার ফাক দিয়ে। নিয়ম ভেঙে। ওই
উপন্যাসে তারপর গুহা অধ্যায় আসে। যা দাবানল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেরানির
বউ" মনে পড়ছে। প্রসঙ্গত, ফিমেল গেজ নিয়ে মারি আন দোয়ানের চমৎকার কাজ আছে।
পুরুষদের
মেয়েদের দেখা নিয়ে অজস্র কাব্য সাহিত্য। অন্যতম সেরা কাজ রলা বারত এর। কীভাবে আমরা
অবজেক্টিফাই করি মেয়েদের। আমাদের অরুণকুমার সরকার প্রতিভা বসু-কে উৎসর্গ করা
কবিতায় লেখেন, ওই দু চোখের পরশ কি যৎসামান্য পাওয়া যাবে। আরও কত।
যেমন মেয়েদের
ভাষাও থাকে। নিজস্ব। এই উত্তর আধুনিক নারীবাদের দিনেও থাকে। কোনও একটি মেয়েকে কোনো
পুরুষ প্রোপোজ করলে, জোর উত্তেজনা লাগে মেয়েটির বান্ধবীদের মধ্যে। চলে প্রবল
খিল্লি। তখন এ ধরণের ভাষা শোনা যায়। বা, শোনা যায়, সন্তান প্রসবের আগে, আতুর ঘরে।
কিন্তু
মেয়েদের দেখা। মাধবীলতা যে ভাবে অনিমেষকে দেখে। বা, কবীরের একটি গানে নারী কন্ঠ
গান, "এখনো সেই পাঞ্জাবিটা/ হারিয়ে যাওয়া সেই চাবিটা/কেমন আছো?" বা,
পুরুষের জামার বোতাম ভাঙা কিন্তু খেয়াল নেই। মেয়েটি তা দেখে ফেলছে। এই মেটাফর
অনেকেই ব্যবহার করেছেন। জোন বায়েজ যেভাবে ডিলানকে গান। টু ববি। বড় মায়ের মত এ সব
দেখা।
ঘরেতে ভ্রমর
আসে গুনগুনিয়ে। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়। এ সব ধরা পড়ে, গলার আওয়াজে। ছোয়ায়। তাকানোয়।
শব্দ চয়নে। যখন নায়ক ছবিতে শরমিলা বলেন, "মনে, রেখে দেব"। বা, মেরা কুছ
সামান তুমহারে পাস হ্যায়...বা,বাঙালি মেয়েদের চিরাচরিত ডায়লগ, "
ভালোবাসা" আর "ভালোলাগা" আলাদা...বুঝতে শেখো..
আর, বিরহ?
সেও বড় বেদনার। রবি ঠাকুরের ছবিতেই নারীচোখ তার প্রমাণ। কি প্রশান্ত। কি হিংস্র।
তারিয়ে তারিয়ে কাটে। যেখানে প্রেমের পাওয়ার প্লে শেষ। সাইলেন্স শুরু। যেন
সাইবেরিয়ার শীত। কি ঠান্ডা। ব্রাত্য দারুণ লিখেছিলেন, আপাতত এভাবে দু জনের দেখা
হয়ে থাক নাটকে, যে লেখক-বরের লেখায় এতদিন অবসেসড ছিলেন স্ত্রী, বিচ্ছেদের সময় তা
পুড়িয়ে ফেলছেন বর। স্ত্রী চলে যাওয়ার আগে শান্ত ভাবে দেখছেন। কোনো এম্প্যথি নেই।
ব্রাত্য লেখেন, কী ভয়ানক শান্ত ওই চোখ। যেন পরম শত্রুরো দেখতে না হয়। মরা মাছের
চোখ যেন। ওহ!
ভেতরে না
বাইরে?
ঈশ্বর, জগৎ,
ব্রহ্মাণ্ড, প্রেম কোথায়?
লালন ও রবি
ঠাকুর বলবেন, ভেতরে তাই বাইরে। ফ্রয়েড খুজবেন ভেতরে। Marx বাইরে। বিবেকানন্দও
বাইরে। কারণ তাকে রামকৃষ্ণ বলবেন, তুই এত স্বার্থপর বিলে! শুধু নিজের ভেতরেই সব
আছে জেনে সন্তুষ্ট থাকবি!!
রামকৃষ্ণর
সমাধি দশা আজকাল ভাবায়। ভাবায়, মানুষের বোধিপ্রাপ্তি। লোক দেখেই বুঝে যাই, কার
ভেতরে বোধিলাভ একটুও ঘটেছে আর কার কোনওদিন ঘটবে না।
এই যে আপনি
বারবার বিয়ের সেল্ফি তুলে ছুড়ে মারছেন, আসলে তো আপনি নিজের থেকেই বিচ্যুত। হতে
পারে আপনার বয়স ৭০। কিন্তু আপনি গ্রো করেননি। আত্মমগ্ন হননি। ঈশ্বর নেই আপনার
মধ্যে। প্রেমের আগুন জ্বলেনি। পুড়ে যাননি। তাই আপনি এত কথা বলছেন। আসলে আপনার
নিজের কোনও কথা নেই। ভাষাহীন আপনি। উজবুক।
অথবা, আপনি
খেলছেন। স্বপ্নের ব্যখ্যায় যেমন ফ্রয়েড শুরুতে খেলার কথা বলছেন। আমরা ছেলেবেলায়
সবাই খেলি মাঠে। বড় হয়ে মাঠ পাই না। কিন্তু খেলি। কখনও তা প্রেমে বা কখনও
গল্পলেখায়। খেলতে থাকি। খেলা থামে না।
রবি ঠাকুর
বলছেন, যে আমার নতুন খেলার জন/ তারই এই খেলার সিংহাসন। বলছেন, চোখের আলোয়
দেখেছিলেম/ চোখের বাহিরে। এই হৃদকমলে রাঙাবে উত্তরীয়...সমাজ সংস্কারক এ দেশে কম
আসেননি কিন্তু মনের সংস্কার?
রবি ঠাকুর
মনের গভীর এই বনের গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে গেলেন। যা জাতির ডিএনএ। বিন্দুতে সিন্ধু।
যেখানে প্রেম। সমাধি। বোধি। আলো।
নীতা কি
চেয়েছিলেন?
একটা ঘর।
সংসার। জীবন।
যখন তার দাদা
তার শিলং এর মানসিক হাসপাতালে গিয়েও জানায়, বাড়ির সবাই খুব আনন্দে আছে,
বাচ্চা-কাচ্চা হয়েছে সবার, হইচই, নীতা কথা থামিয়েই চিৎকার করে
দাদা আমি
কিন্তু বাচতে চেয়েছিলাম
ক্যামরা ৩৬০
ডিগ্রি প্যান করে ঘুরতে থাকে। আসমুদ্র হিমাচল একাকার হয়ে যায় সে চিৎকার। ইতিহাস ও
সাম্প্রতিক ভেঙে তছনছ করে। ছিটকে এসে রক্ত লাগে সমগ্র পুরুষতন্ত্রের সাদা
পাঞ্জাবিতে।
রবি ঠাকুর
নীতাকে নিয়ে গান লিখলে লিখতেন, সকল গৃহ হারালো যার...। ঋত্বিক গ্রেট শিল্পীদের
মতোই বড় নিষ্ঠুর। যেমন রবি ঠাকুরও। কিন্তু তারা কি জানতেন, আর তিন দশকের মধ্যে
মেয়েদের ভূমিকার এমন বদল ঘটবে? সমাজের ভারসাম্যই যার জন্য যাবে বদলে?
আমার
প্রজন্মেই ব্যপক হারে মেয়েরা সিঙ্গল ওমানহুড চাইল। পাশ্চাত্যে অনেক আগেই এই মোটিফ
দেখা গিয়েছিল। আমাদের এখানেও ছিল। কিন্তু এত ব্যপক হারে হয়তো না। মেয়েরা আর
"সংসার" চাইল না। কলেজ পাশ করার পর, তারা অনিশ্চিত কোনও একটা কাজের
সূত্রে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে লিভ-ইন করে নিল। দেখল, এ আসলে সংসারেরই ব্যপার। নতুন
বোতলে পুরোনো মদ। তাকেই চাকরি থেকে ফিরে রান্না করতে হচ্ছে। তো, সেই মেয়ে বেরিয়েও
এলো। কলকাতা মা-বাবা"র কাছেই ফিরে, কুকুর/বেড়াল পুষে, কম্পুটারে কাজে ঢুকে
গেল। মাঝেসাজে এদিক ওদিক ফ্লারট করে নিল। যেমন পুরুষরাও করে।
জোর দিয়ে
বলব, ব্যপক হারে আমার প্রজন্মে এই মোটিফ দেখা গেল। মেয়েদের মধ্যে। আমাদের আগের
প্রজন্মের লেখায় এই মোটিফ আসেনি। সন্দীপন খুব কাছে গেছেন। কিন্তু না, এই চিহ্ন
নেই। ধরার সুযোগ পাননি। নবারুণ অন্য ভাবে ধরেছেন, "বেবি কে" জাতীয়
লেখায়।
আপনি বলবেন,
মেয়েরা ফেমিনিটি হারালে তো ঘর ও বংশ ও রাষ্ট্র টলে যাবে। আমি একমত হব না। এটা ঠিকই
ফেমিনাজিরা বদলা নিতে চায়। কারণ যুগ যুগ ধরে পুরুষ তাদের পুজো করেছে আর রড
ঢুকিয়েছে। কিন্তু এমন অনেক মধ্যবিত্ত পড়ালেখা জানা নারী আগের প্রজন্মের আমি
দেখেছি, যাদের স্পেস চাইতে আদালত বা ফেসবুকে আসতে হয়নি। তারা সংসার সামলেই নিজের
অধিকার বুঝে নিয়েছেন। আর সে সংসারে কোনো এক্সপ্ল্যেটেশন নেই। আমার চারপাশে যে
বন্ধুরা বিয়ে বা সম্পর্কে আছেন, এমন ভাবেই আছেন। আমি তাদের মধ্যে আগামী ৫০ বছরের
বাংলাদেশ দেখতে পাই। দেখি ধানখেত আর নারকেল গাছ।
একটা শিশু
ছোয়া চায়। বুকের লাবডুপ চায়। না পেলে, সে ভায়োলেন্ট হয়। ইন্টলারেন্ট হয়। যেমন
মানুষের ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি আসছে সেই পথেই। শীতকাল কবে আসবে সুপরণাই
জানেন। নয়তো বড্ড বেশি ঠান্ডা লাগবে। নীতার সাথে যা হয়েছে তা মানা যায় না। কিন্তু
তা বলে নীতা ঘরের স্বপ্ন না দেখে নাজি হবে তাও তো মানা যায় না? আপনি আমায় লারজ ভন
ট্রায়ার বেস মোয়া দেখালেও যায় না। বাভোয়া নিজে ঘরে ছিলেন। সংসার আর নারীবাদের
রসায়নটা নিয়ে কি আরেকটু ভাববেন নারীবাদীরা? আমরা পুরুষরা তো মাথা নীচু করেই আছি
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। আগের প্রজন্মের দায় শোধ করছি।
কিন্তু তোরা
কি আরেকটু ভাববি? সবাই না কেউ কেউ। সন্তানের দোহাই!
এ সব শীতে
তাই মায়ের প্রসব ব্যথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, মার দিকে তাকানো হয়নি বহুদিন। সারা জীবন
মা ঘুমননি ভালো করে। কারণ আমার স্কুলবাস এসে যাবে। কারণ আমার কলেজ আছে। কারণ আমার অফিস। মনে পড়ে,
মার দিকে তাকানো হয়নি বহুদিন, ভালো করে। মায়ের প্রসব ব্যথা মনে পড়ে। পাপবোধ হয়।
ছেলেবেলার খেলনা মনে পড়ে। মনে পড়ে সাবানের গন্ধ। কুয়াশা ঘিরে ধরে শহর। মানুষ আস্তে
কথা বলে। নিজেদের গরম জামায় সাজিয়ে রাখে। মনে হয় শহরের কি-যেন-এক রোগ হয়েছে। যা,
সারবে না। আইসিইউ তে। কোমায়। তবু খুচরো রোদ সেই ঘা ঢেকে দেয়। মাঝেসাজে। বাহারি
টুনি জ্বলে সবুজ পাতার ফাকে। কাফে। মেরুন-হ্লুদ ফুল ফোটে। দ্রুত সন্ধ্যা নামে।
হলুদ ল্যাম্পোস্টের স্পটলাইটে হাতে-হাত হেটে যান শম্ভু আর তৃপ্তি মিত্র।
খুব
ছোটবেলার হিন্দি সিনেমায় ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে মাধুরী দীখ্যিতের দিকে
তাকিয়ে মরে যাই। "তুম সে মিলকে..এয়সা লাগা তুমসে মিলকে" যে ভাবে গান
মাধুরী। সন্দীপনের মতো বলতে ইচ্ছে করে, আমার আর কোনও অসুখ নেই। ইচ্ছে করে শুধু
শুনে যাই, "প্যাহেলা নেশা প্যাহেলা খুমা"। প্রথম প্রেমিকাকে মনে পড়ুক।
মনে পড়ুক, আমাদের এইট-বি তে বসে থাকা। আজ কাল পরশু তরশু। রাত আটটা। দোকান বন্ধ
করছে মাসি। সামনে নিভে আসে কলকাতা। আমাদেরো বাস ধরতে হবে। আমাদের মাথায় কেউ জল
ঢেলে দেয়। তার পর অপঘাতে কাটা দুটো লাশ মেলে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোয়।
বড়
অসুখের কথা মনে পড়ে এ শীতে। তাই গোয়া চলে যেতে ইচ্ছে করে। সবাই যেমন পালচ্ছে। আমিও
পালাতে চাই। কিন্তু দিনান্তে ইন্দির ঠাকুরণের মতো ফিরেও আসি। গজগজ করতে করতে। মা-র
কথা মনে পড়ে।
মনে
পড়ে মা-র প্রসব যন্ত্রণা। মনে পড়ে মার দিকে তাকানো হয়নি বহুদিন ভালো করে। কারণ, মা
ধরে ফেলবে আমি যন্ত্রণা পেয়েছি। প্রসব যন্ত্রণা। ১০ মাস ১০ দিনের। নিজে হাতে খুন
করেছি প্রেম। করতে হয়েছে। সুপারি দিয়েছে সময়। মা জানত, আমি ভালোবাসার কথা বলতে
চেয়েছিলাম। তাই বুঝতে পারবে না, কেন এমন লাশকাটা ঘরের মত ঠান্ডা শহর। প্রেমের শহর।
কেন সবাই পালাচ্ছে। আর বিয়ে করছে। আর কুয়াশায় আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
আরো। আরো।
মানুষ
মারা যাওয়ার আগে কিছু কথা বলে যায়। প্রেমিকা ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন কিছু কথা বলে।
এ
সব কথার ওজন খুব বেশি। সবার নয় এ সব কথা। বৌদ্ধরা তাই ভাইব্রেশন বুঝে, যার বুকে
বুদ্ধ আছে, তাকেই বলে যান এ সব।
কেউ
তার বই দিয়ে যান লাইব্রেরিতে। কেউ ফ্ল্যাট দিয়ে যান মিশনকে। কেউ অস্ত্র দিয়ে যান
লড়াইয়ের। কবীরের গানে, কোনও সন্তানহারা মা জোড়া মুনিয়ার খাচা খুলে দেন।
দিদা
সুরমা ঘটক যেমন বলতেন, ঋত্বিককে তো বাচিয়ে রাখতে হবে! সঞ্জয়দা কাল যখন বলছিলেন,
নীতাকে লো এঙ্গেলে যে রাতে মোর গানে ঘটক যেভাবে দেখেন তা বুজোয়াদের এতাবৎকালের সব
দেখা ভেঙে দেয়। আমি দেখলাম, ওই মুহূর্তে ঘটক বেচে উঠলেন। বেজে উঠলেন। ঋত্বিক
যুক্তি-তক্কো"র শেষে
যখন বললেন, কিছু একটা করতে হবে তো...মানিকবাবুর মদন তাতি মনে কর..সেটা তার অন্তিম
উচ্চারণ। সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরলো তাতে।
প্রতুলদার
গান নিয়ে একটা বড় ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তাতে উনি বলেছিলেন, মা মারা যাওয়ার আগে
যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মনে হচ্ছিল, সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরতে চাইছে। ঢুকে
আসছে শরীরে। ট্রান্সমাইগ্রেট করতে চাইছে। যেমন পুশকিনের আত্মা ডস্টভয়স্কির শরীরে ও
পরে কালভিনোর শরীরে ঢুকে যায়।
আমি
মানুষকে মারা যাওয়ার মুহূর্তে দেখেছি। আপনারা দেখেছেন? দেখেছি পায়খানা করে ফেলছে
মানুষ। বা মদ ঢেলে দিচ্ছে স্ক্রিনে। বা, দেবদূতের মতো পরীর হাতে বিলিয়ে দিচ্ছে
আত্মা। নীল চোখ নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ছে কফিনে। গুরুস্থানীয় কিছু মানুষ আমায় কিছু কথা
বলে গেছেন। যা, আমি এ জীবনে কাউকে বলতে পারব না।চেষ্টা করব, সে কথার সম্ভ্রম
রাখতে, কাজে।
মাঝে
মাঝে, মারা যাওয়ার কথা ভাববেন। দেখেবন মনে হবে, সমুদ্রের সামনে বসে আছেন। বুনুয়েল
যেমন ডাইরিতে রীতিমত ফ্যান্টাসি করে ফেলেছিলেন কীভাবে মারা যাবেন তা নিয়ে। বাথরুমে
না দেবালয়ে। প্রেমিকাদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোর কথাও ভেবে গেলেন পরপর সেই
মাহেন্দ্রক্ষণের আগে।
ট্রেন
যদি জীবন হয়, কাশবন পেরিয়ে অপু কিন্তু তা দেখতে পেল, দুর্গা পেল না। পা মচকে পড়ে
গেল। নারীবাদী ব্যখ্যায় রুশতী সেন এমনটাই লিখেছিলেন। বা, অপরণা"র মারা যাওয়ার
খবরে থাপ্পর মারে শিল্পী অপু। মুখ বেকে যায়। মাও বলেন, কারও মারা যাওয়া পাহাড়ের মত
ভারি আর কারো পালকের চেয়েও হালকা।
সন্দীপনের
লেখা প্রসঙ্গেই একবার সঞ্জয়দা লিখেছিলেন, সন্দীপনের লেখা জুড়ে সম্প্রসারিত এপিটাফ।
সমস্ত লেখক জীবনানুগ হলে সন্দীপন মৃত্যু অনুসারী।
মানুষ
মরে যায় ঠিকই। মানব থেকে যায়। আর তাকে অগ্রজের কাজের ভারও শোধ করতে হয়, এক জীবনেই।
চুল্লিতে হাত-পা-মাথা-ঘিলু ফেটে যাওয়ার আগে!