Friday, December 14, 2018

কবিতা- মনোনীতা চক্রবর্তী





রাতফুল...


সিরাজ,
       সেদিন যেখানে থেমেছিলাম, সেই থামা থেকেই একটা রাস্তা হিলকার্ট রোড হয়ে ডানদিক ঘেঁষে আরও কিছুটা বাঁ-এ গিয়ে থেমেছে।

      সেদিন যে-ক'টি বাঁকবদলের আক্রোলিক ছবির ক্যানভাস দেখিয়েছিলাম, বাদামি-আলোয়-- সেখানে এখন ফুরফুরে-পালকের মতো ওড়ে শুধু কড়া-মাদকের খুশবু আর মেল-ডি'ও...

একটা নিঃসঙ্গ গমক্ষেত । ভেসে-ভেসে আসে সমবেত এসরাজের বলা-বলি। আমি হাসিটুকুই শুধু রেখে এসেছি ,সিরাজ। সেদিন থেকে যেদিন আমাকে আঁকতে ,ডেকে এনেছিলে এখানে আর তুলি খসে পড়েছিল অলৌকিক এক হওয়ায়...

    সিরাজ, তোমার গা-থেকে খুলে যাচ্ছিল নাগরিক-মিথ্যে। মিথ্যে-মিথ্যে ছবির কড়া-মায়া। তোমাকে সি-অফ করতে আসার বহু-বহু যুগ আগে থেকেই ঢলঢলে চুড়ির মতো হাত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বলিনি কখনও। সিরাজ, ঘরটা সেদিন থেকে অন্ধ হল চিরকালের মতো। আমার বাসন্তী রং ডানা হারালো। হারালো সব যতিচিহ্ন।
    
      সিরাজ, সেই থেকে ঘরটার সাথে-সাথে আমিও চোখে অন্ধ পরলাম। অন্ধ আমি নকল সাজতে-সাজতে কখন যে সত্যিই দৃষ্টি হারালাম,মনেও নেই। তারপর ঘুমও। ভীষণ দৌড়নোর আনন্দে আচমকা জেগে উঠি। হাত বোলাই হুইলচেয়ারে... হাত রাখতে চাই কত কত কিছুতে...! চোখে হাত রাখতে গিয়ে দেখি,চোখ নেই। হাতও তো নেই। কিচ্ছু নেই। লেয়ার-কাট চুল উড়ছে মহাশূন্যে! মাথা-গলা কিছুই নেই। আসলে ,কোত্থাও নেই চরাচরের--- মাংসের দলায় নেই,দোলে নেই... ভিসা-পাসপোর্ট, কোত্থাও নেই... মনসমঙ্গল থেকে হিচকক,কোত্থাও নেই।
 সিরাজ, ওই হুইলচেয়ারটাই আসলে আমি। হুইলচেয়ারটাই ...





শরীর থেকে  শুধুই জল-শব্দ
আমার ভেতর একটা আস্ত নদী রেখে তুমি বেরিয়ে গেলে।
শুধু শুকনো পাতার মাড়িয়ে যাওয়া আওয়াজ...

প্রতিটি সঙ্গমের পর এভাবেই জল হয়ে উঠি। চোখ বুজে আঁকড়ে রাখি ভীষণ! আমার হাত গলে বয়ে যায় জল...

সে-বার আমার কোলে যখন বসন্তবউরি এসে বসেছিল, তুমি তখন অর্ডার করছিলে রেশমি-কাবাব। আমার পছন্দের।আমি বসন্তবউরির সাথে সেরে ফেলেছিলাম সমস্ত কথা।

আমি জানি, পর পর শুয়ে থাকা লাশেদের পরিচিত শোক নিয়ে তুমি আবারও লখিন্দর হবে।আমি সেই বেহুলা...

 নদীর ওপর নদী।
জলের ওপর জল।
তোমার তামাটে-পিঠে আমার যমুনা ... আঁচরের দাগ...




এই যে রোজ তুমি আমাকে ভালোবাসছো। নগরীর অলিগলি চিনিয়ে রেখে যাচ্ছ বকের মতো, বরফের মতো ভালোবাসা। রবি ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র শুনতে-শুনতে কুচিকুচি করেছি শুধু। 

 কে যেন বলেছিল, অপেক্ষা ফুরোনো মানেই 'দ্য এন্ড'..
একদম সত্যি। বিন্দু ভুলও নেই ।


ঘরের দরজা আমি ভেজিয়ে রাখতে অভ্যস্ত নই। ছিটকিনি তুলে রাখতেই পছন্দ বেশি।

এখন রাত দুটো বাইশ। তুমি সবুজ। নিয়মমাফিক। আমি একগলা  গ্লেন্ডফিডিকে বর্ষা নামিয়েছি এই রাশপূর্ণিমায়  দিব্যি দিয়ে বলছি, সান্ত্বনা-পুরস্কার পেতে-পেতে  গায়ে জলবসন্তের ওপর  হাত-বোলানো একটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু উঁচু-নীচু হলেও , একটু অমসৃণ জলজলে হলেও।

ঘুঘুর ডিমের মতো চোখ করে এই যে রোজ মূল্যবোধের গ্রাফিক্স আঁকছ, তাতে শুধু দেখি বাহারি রং-ডানা। এই ধরো, সব লোককে বোকা বানাতে বানাতে, আসলে তুমি ক্রমশ ঘুমের কাছাকাছি চলে যাচ্ছ। 

আমি  সীমাহীন তোমার মিথ্যের চোখে বেঁধে দিই লাল-নীল স্কার্ফ।

আমার পিছু নেওয়ার ঘোর কেটে গেছে
আমার হাতে অন্ধকার, জল ,বরফ আর ছেনি-হাতুড়ি .. চোখের সামনে সাদা-কাগজে আলতা-ছাপ জোড়া পা।

"আমি তখনও ছিলেম মগন-গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল...''





তোমার নেশা বাড়লে , রাত্রির প্রৌঢ়ত্ব  বাড়ে ঘন হয়ে।
সবুজ ঘোরে নিয়ে ঘর-ভাঙ ও নিয়মমাফিক।
সি সি উ ইউনিটে আমার বাবা অথবা বাবার মতো কেউ আমার অপেক্ষায় ভীষণ! 

আমার পা থেকে সবক'টা কেয়াপাতার ঘুঙুর  খুলে দাও আমার প্রিয়তম,আমার ঈশ্বর..
খুলে দাও ... খুলে দাও...


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম