Saturday, December 15, 2018

ঈশানী বসাক -- রূপকথা, সে তো আ মিডসামার নাইটস ড্রিম







নীলকুরিঞ্জি ফুলের কথা মনে পড়ছিলো সকাল থেকে। ভূমিকা লিখতে কোনোদিনই পারদর্শী নই। সে সাজসজ্জা থেকে বঞ্চিত। হঠাৎ মনে হলো ছবি, আঁকি তাই আঁকলাম। বেঁচে থাকাগুলো কলমের মতো। কালি থাকলে ছাপ দিই কাগজে , না থাকলে রিফিলের আশায় কত অক্ষর মরে যায়। তা নিয়ে দুঃখ হয়নি কখনো।
একদিন বোন এসে বারান্দায় হালকা শীতের বেলায় রোদে বসে রঙ করছে ছবি। যে জায়গাটা ও আঁকছে সেখানে ও থাকবে বড়ো হলে। এই জায়গাটায় আকাশ আর গাছেরা নীল, বটলগ্রিন রঙের ঘাস যেন জলের তলার গ্রাম। সদাই চড়ুইপাখির মতো কিচিরমিচির করছে ময়ূর গাছে গাছে । তাদের নীল গলা আর গাছের নীল পাতা মিলেমিশে একাকার।

" এই গাছের পাতা নীল, ময়ূর নীল। বুঝবো কী করে ?"

" লুকিয়ে ফেলেছি দিদি । নইলে যদি শিকারীরা মেরে ফেলে। ময়ূরগুলো বাঘের মতো হাওয়ার গতি বুঝে নিজেকে মিশিয়ে ফেলবে গাছে।"

বাঘকে ময়ূরের সঙ্গে তুলনা কেউ করেছে শুনিনি। সরল সেই কল্পনার জগতে আমি বেমানান ,অনুপ্রবেশকারী। শিশুদের ভাবনাতে মেদ ছিল না কখনো। বললাম," তোর এই জায়গাটায় নীলকুরিঞ্জি ফুল ফোটা। সেই যে ফুল কেরালাতে ফোটে বারো বছরে একবার।"
হাততালি দিয়ে ও বলে ওঠে, " আমার এখানে প্রতিবছর ফুটবে দেখিস দিদি।"
ওর এই গ্রামটির পাশে একটা নদী। সেই নীলকন্ঠী জলে ও নৌকা আঁকছে, ভেসে পড়ার নৌকা। চলে যাবার নৌকা।চোখে জল আসছে নাকি , কই না তো। এমন রূপকথার কাব্য ,আমি কেন কষ্ট পাবো? বালাই ষাট। চোখের সামনে দেখি ও ব্যাগ গোছায়। স্কুল থেকে এসে লক্ষ্মী ভাণ্ডারে পয়সা ফেলে। ও বড়ো হলে নীলমণি গ্রামে যাবে। " হ্যাঁ রে টিকিট কোথায় পাবি?" বলে ওঠে ," কেন বড়ো হয়ে গডকে বলবো আমার এই লক্ষ্মীভাণ্ডার নিয়ে তার বদলে ওখানে নিয়ে যেতে।" এই বিপ্লবটুকু ওর রূপকথা। ওর মতো করে ও এঁকে চলেছে সেই গল্প নিজের বয়স, শেখার সিঁড়ির ভিতর দিয়ে। অথচ একদিন এই গল্পটায় ও না পৌঁছাতে পারলেও ভেবে নেবে ঘুমের ঘোরে যে সেখানে আছে ও। তখন বুঝি ও বড়ো হয়ে যাবে।
আসলে আমাদের বাঁচার স্বপ্নগুলো কেমন ক্লিশে হয়ে যাচ্ছে। বাঁচার রূপকথাগুলো কেউ আর লিখে দেয় না। আমরা সবাই দুয়োরানি আর অবন ঠাকুর সেই ক্ষীরের পুতুল এঁকে ফেলেছেন। সেইটুকু রঙিন পাতা আমাদের পড়ে পাওয়া চার আনা।
আমি যখন ছোট্ট ছিলাম তখন আমার ও অমন একটা ঠাকুরমার ঝুলি ছিল। যখন দাদু এম এল এ ফাটাকেষ্ট দেখ তো আমি ভাবতাম যদি আমি হতাম কখনো এ দেশের হর্তাকর্তা তবে চারিদিকে থাকতো তালগাছ, আমবাগান, কাঁঠাল গাছ, খেজুর গাছ, সবেদা গাছ। সুগার স্পাইসের বাক্সের মতো বাড়ি থাকতো না। কুঁড়েঘর থাকতো বেশ। সেখানে রোজ রাতে বাবার কাছে কম্বলের তলা থেকে শুনতাম লালকমল আর নীলকমলের গল্প। রাক্ষসদের ভয়ে কোনোভাবেই যেতাম না রান্নাঘরের দাওয়ায়। ভাবতাম মেয়েটি ছেলেটির জন্য ট্রেনের পিছনে ছুটবে আর গান বাজবে ব্যাকড্রপে, কেয়া ইয়েহি পেয়ার হ্যায়। এখন ও বেঁচে আছে হয়তো সেসব স্বপ্ন তবে কত কেতাবী জ্ঞানের মধ্যিখানে। হ্যাঁ এখনো ভাবি অমন আমকাঁঠালের জঙ্গল থাকবে। দেশে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এই উষ্ণায়নের যুগে গাছ বাড়ুক, সবুজ হোক বিশ্ব। ভূমিকম্প এড়াতে চলে আসুক আবার সেই মাটির বাড়ি। জানেন তো রূপকথারা প্রিয় পুরুষের মতো। আমাদের ভিতরে বেঁচে থাকে। তাদের বয়স বাড়ে না।
আমার পরিচিত এক মানুষের কাছে শুনেছি মধুবালার কথা। তাঁর রূপকথায় মধুবালা তাঁর ঘরণী। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি নাক খুঁটছেন, ঝগড়া করছেন আর বলছেন , কই গো এত দেরি কেন ? বাজার যাও, বেলা পড়ে এলো। এটা তার জীবনের সেই অধরা রূপকথা। তবুও এইসব স্বপ্নের মাঝে সে জানে ওই কই গো বলে মধুবালা তাঁকে যদি ডাকে তাহলে তার সমস্ত গল্পগুলো ভেঙে যাবে।
আরেকজনের কাছে শুনেছিলাম এক গল্প। তিনি ভাবেন বচ্চন যদি তাঁর বাবা হতেন। আমি বলেছিলাম , খুব খারাপ হতো। তোমাকে খুব বকতো। তাই হতো সে বলতো। অ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান বলে কথা। সে ভাবতো বচ্চন যখন ঝুম বরাবর গানটা গাইছে সেও বাবার মতো ওই কাউবয় স্টাইলে সাজতো। মনে মনে বাগবান সিনেমার সেই আদর্শ লক্ষ্মী ছেলেটি হতো। সব কথা শুনতো তবে বাবার। তাঁর আর বাবার বাধ্য হওয়া হলো না। বচ্চন তো বাবা নয় তাঁর এ জন্মে। তাঁর রূপকথা সেই বাধ্য ছেলের গল্প।
আমাদের নকশালবাড়ি , তেভাগা, তেলেঙ্গানা কিছু দেখা হয়নি। তাই সেসব ইতিহাস আমার কাছে রূপকথা। প্রতিটা বাঙালিবাড়ির একটা নিজস্ব ইতিহাস নকশাল এর। সেই মা বাবার ছেলেকে লুকিয়ে রাখা। বউয়ের কাছে রাত কাটিয়ে সকাল থেকে পুকুরের জলে ডুবে থাকা সারাদিন। জানেন সেই বৃদ্ধ লোকটা এক পাশে শ্মশানের দাঁড়িয়ে। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে এখানে সদ্য একুশে তার বন্ধু বিশ্বরূপ মরে গেছিল। না না ভুল বললাম , মেরে ফেলা হয়েছিলো তাকে। সেই লোকটা আজ ও বাবলুর কথা ভাবে যে মা কে আসছি বলে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। মা আজ ও দুয়ার খুলে বসে। তখন তিনি খালি ভাবতেন স্বপ্নের কথা। তাঁর ছেলে ফিরে আসার রূপকথা।
সেই সর্বসমক্ষে গুলিতে এঁফোড়ওফোড় করে দেওয়া ছেলেটার প্রেমে আমি আজ ও। যাকে পুলিশ খোলা মাঠে আছড়ে ফেলে বলেছিল," রান বাস্টার্ড রান"। তারপর পালিয়ে যাওয়া ছেলেটার পিঠ দিয়ে চলে গেছিল গুলি। ওর পালিয়ে যাবার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পরে বুলেট বুঝেছিল রক্ত কখনো হিংসা করেনা। কে সেই ছেলেটা ? জানিনা তো। আমি জানি আমি তাকে খুব ভালবাসি। খালি চোখের সামনে আদিগন্ত ধানক্ষেত আর তার মাঝে মলিন সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবিতে সে দাঁড়িয়ে। আমাকে বলছে চলো পালাই এই বাবা, মা, শহর , গ্রাম সব থেকে দূরে। কোথায় যাবো? জানিনা জানিনা তা। কোথায় যাবো জানলে পিছুটান থাকে। প্রথম প্রেম শিখিয়েছিল ফেরার টিকিট কেটে কোথাও যাসনা। তবে যে বাঁধা পড়ে যেতে হয়। সেই ধুতি পরা ছেলেটির হাত ধরে দৌড়াই। আমার ঘর বাঁধার রূপকথা নেই তবে সেই না দেখা প্রেমিকের গল্প আছে।
দুটো প্লেন এসে সজোরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ধাক্কা দিলো। তোমরা শিউরে উঠেছো। আমি তো তখন আট। বুঝিনা কী ক্ষতি হচ্ছে। নিজের ছোট ছোট হাতে আমি প্লেন চালাচ্ছি তখন। দেওয়ালে ঠুকছি প্লেন। ভাবছি ঠিক এইভাবে গিয়ে বাড়িটাকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলবো। কী নৃশংস সেই স্বপ্ন অথচ বুঝিনি তা। শিশুরা সরল ভাবে ভয়ঙ্কর।
এখন বড়বেলায় সেসব ভিলেন রূপকথা বলিনা। আমাকে কেউ খারাপ ভাবলে? অথচ আমরা কী কেউ ভালো ? জানিনা তো। এখন কই সেই চিমনি সুইপারের মতো তরতর করে রূপকথার চিমনি পরিষ্কার করতে পারি বেশ। আমাদের রূপকথা জড়ানো শরীর নীলকুরিঞ্জি ফুলের কথা ভাবে। তবু পাপের ঘোরে সেই কবিতাটা মনে পড়ে, টাইগার টাইগার বার্নিং ব্রাইট।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম