Saturday, December 15, 2018

শুভদীপ নায়ক- হারানো ডানার স্মৃতি







পাহাড়প্রদেশ থেকে দূরে যে জঙ্গল পাহাড়ের পাদদেশকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে , তার প্রায় অনেক গভীরে একটা কালীমন্দির ছিল । মন্দিরটি জীর্ণ নয় , তবে পরিত্যক্ত । স্থানীয় মানুষজন এখানে খুব একটা আসে না । ইংরেজ আমলে এই মন্দির হয়ে উঠেছিল স্বদেশিদের আখড়া । মিটিং এবং পরিকল্পনা করার একটা সুনিশ্চিত জায়গা । কেননা ত্রিপুরা রাজ্য ইংরেজদের অধীনে ছিল না । এখানকার রাজাদের নিজস্ব একটা শাসন ছিল । ইংরেজদের মহলে এখানকার রাজবাড়ির বিশেষ নামডাক ছিল । রাজনৈতিক স্বার্থে সমগ্র ভারতের মধ্যে কিছু কিছু জায়গা ইংরেজরা দখল করেনি , তার পরিবর্তে সন্ধি করেছিল । যাতে ব্রিটিশ রাজত্বে বিদ্রোহীরা একত্রিত হতে না পারে । ত্রিপুরার একেবারে শেষপ্রান্তে এই একটা নির্জন পরিবেশ, যেখানে স্বদেশিরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারত , ব্রিটিশদের সন্দেহের চোখ পড়ত না এঁদের ওপর । সেসব অবশ্য এখন ইতিহাস, তারই নিদর্শন এই  মন্দির । 


স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সূর্য এখানে চলে আসে । এখানে বলতে এই জঙ্গলের কাছাকাছি একটা ছোট বসতিতে । নদীর চরের কাছে ভূগর্ভস্থ গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে । প্ল্যান্ট বসবে ভবিষ্যতে । অয়েল কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে তাকে এখানে এসে থাকতে হচ্ছে । অনেক শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, ঘরামি, ট্রাকচালক, ভূতত্ত্ববিদ সবাই এই দুঃসহ জঙ্গলের কাছাকছি এসে বসতি গড়েছে । প্রথমে জঙ্গলের একাংশ কেটে তৈরি হয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া কাঠের বাড়িঘর । তারপর সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে । রাস্তা তৈরি হতেই সেখানে দোকান বসেছে । তবে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অনেকটাই আসে ট্রাকে করে, দূরের শহর থেকে । একজন ডাক্তার আছেন, তিনি অবশ্য এক ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী । রোগে পড়লে সাময়িকভাবে তার কাছেই চিকিৎসা করাতে হয় সকলকে । কেননা, হাসপাতাল এখান থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে । মধ্যরাত্রে প্রাণটাকে কাঁপিয়ে আর্মির ট্রাক চলে যায় রাস্তা দিয়ে । খনিতে ড্রিলিং করার সময় সমগ্র বসতিটাই যেন নড়ে ওঠে । মনে হয়, হঠাৎ ভূমিকম্প গ্রাস করেছে । যে চিমনি থেকে গ্যাস বের হয়, তার মুখে দিনরাত আগুনশিখা জ্বলে । পর্যাপ্ত গ্যাস-ভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া গেলে কোম্পানি তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনবে । 


নারীরা এখানে হাতে গোনা । যারা আছেন তারা কারোর না কারোর স্ত্রী, কন্যা । কেননা বেশিরভাগ লোকই এখানে তাদের পরিবার নিয়ে আসেনি । তবে যে সমস্ত পুরুষমানুষ এখানে সস্ত্রীক এসেছেন , তাদের স্ত্রীদের একরকমের পরিবর্তন এসেছে । আগের মতো তারা আর পতিব্রতা নেই । পুরুষদের সঙ্গে তাদের সহজ সখ্যতা তৈরি হয়েছে । এতে কেউ কেউ বেশ সম্মান পেয়েছেন, কেউ কেউ দারুণভাবে বদনামের শিকার হয়েছেন । সূর্য অবশ্য একাই থাকত । কোম্পানির কাছ থেকে অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে তার স্ত্রীর চিকিৎসা বাবদ । এই কষ্টের কাজে যদি দু’পয়সা বাড়তি আয় হয় , তা হলে দেনাটা মিটিয়ে অন্তত আত্মসম্মানটা বাঁচানো যাবে । যারা মুখে বলে আত্মসম্মানবোধটা তাদের কাছে সবচাইতে বড় , তারা ‘দায়’ জিনিসটা সম্পর্কে কিছুই জানে না । দায়ে পড়ে যে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হল, তেমন আত্মসম্মান নিয়ে জীবনে আর যাই কিছু হোক গর্ব করা সাজে না । স্ত্রী রোহিনীর ক্যান্সারে  সূর্য যখন প্রায় আর্থিক দিক থেকে নিঃস্ব , তখন সে শ্বশুরের কাছে বাধ্য হয়েছিল হাত পাততে । ভালমানুষ শ্বশুর তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল ঠিকই , সঙ্গে বলেছিল, 'দ্যাখো বাবা, তুমি তো সবই বোঝো ! আমার ঘরে তো ছোট মেয়েটাও আছে , তার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে বলো ? তাকে তো ফেলে দিতে পারি না । বড় মেয়েটা তো আমাদেরকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইছে । ’


কথাটা শুনে তার মতো ধৈর্যসম্পন্ন পুরুষের বুকেও হাতুড়ির বাড়ি পড়েছিল । যার মেয়ে মৃত্যুশয্যায় , সেই জন্মদাতা পিতাও কিনা এমন কথা মুখে আনতে পারে ? হায় ! টাকা জিনিসটা কতটাই না ঘৃণ্য পদার্থ । শেষ অবধি রোহিনী মারা যায়, তারপর অবশ্য শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সূর্য কোনও সম্পর্কই রাখেনি । কলকাতায় সমস্ত কিছু ফেলে রেখে এখন সে এই নিবিড় জঙ্গলের কাছে এক শান্ত বসতিতে বাস করছে । এখানে অচেনা মানুষের উপস্থিতি । দিনের কাজ আর সন্ধের অবসরে বইপত্র নিয়েই ব্যস্ত থাকে সে । দু’একদিন মদ্যপান করে পড়ার টেবিলে বসে, টেবিল-ল্যাম্পের নীচে রোহিনীর ছবিটা এখন আগের চাইতে বেশি মোহময় । মানুষের অনুপস্থিতি যেন মানুষের উপস্থিতির চাইতে বেশি গাঢ় । নেশা বেশি হলে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সূর্য । খনির ড্রিলিং শুরু হয় ভোরবেলায় । সেই আওয়াজেই ঘুম ভাঙে সূর্যর । কিন্তু মাস ছ’য়েক আগে মধ্যরাত্রে একটা কাচ ভাঙার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায় । ঘটনাটির সূত্রপাত সেই থেকে । এই অবিশ্বাস্য ঘটনাকে এতকাল লোকে বিশ্বাস করত ভৌতিকরূপে । কিন্তু  সূর্য , সূর্য তা বিশ্বাস করেনি কোনওদিনই । তাই রোহিনীকে ছাড়াও আজ তার আরেকটি বিষয়ে নীরবতা কাজ করে । আরেকটি মন, আরেকটি নীলচে-সাদা শরীর, আরেকটি জীবন তাকে ভাবায়, —এও কি সম্ভব ! এমনও হয় পৃথিবীতে ? এই সনাতন ভারতবর্ষে ?



বিছানা থেকে উঠে পড়ে সূর্য । বালিশের পাশে সে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে ঘুমাতে যায় আজকাল । প্রৌঢ় ম্যানেজার অতনুবাবু সেদিন বলছিলেন এখানে ভাল্লুকের উৎপাত খুব বেশি । বাইরের বারান্দাতে রাত্রিবেলা যেতে মানা করেছিলেন । সূর্যর একবার মনে হল , দোতলার বারান্দায় তো ভাল্লুকের ওঠার কথা নয় । ইতস্তত বোধ করে ঘরের আলোটা জ্বেলে ফেলল সূর্য । মাটিতে ভাঙা মদের বোতল পড়ে , ছড়ানো কাচ । নীচু হয়ে বোতলের সবচয়ে বড় ভাঙা টুকরোটা সে কুড়িয়ে নিল । ছোট টুকরোগুলোকে একত্রিত করতে গিয়ে তার চোখ পড়ল বিছানার নীচে । সেখানে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে এক নারী । কতকটা নীল, খানিকটা ফর্সা তার গায়ের রঙ ,অন্ধকারে মুখটা চেনা যাচ্ছে না ঠিকই তবে শরীর যথাসম্ভব অাড়ষ্ট , যেন ভয় পেয়ে আছে  । ঋজুদেহে সেই ভয়েরই লক্ষণ । মাথায় চুলের বন্যা । পিঠে চাদরের মত একটা কী আছে যেটা ভালভাবে লক্ষ করতে পারল না সূর্য । ঘরের মধ্যে আলো থাকলেও বিছানার নীচটা অন্ধকার ।  সূর্য উঠে গিয়ে টর্চ আর ছুরিটা নিয়ে এল, কেননা এ মেয়ের কাছে যদি অস্ত্র থাকে ! টর্চের আলো ফেলতেই বিছানার নীচে ফুটে উঠল এক নক্ষত্রখচিতা সুশোভিতা যুবতীর দেহ , যার সর্বাঙ্গে লালিত্য । কিছুক্ষণ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে রইল সূর্য । তারপর হঠাৎ নজরে এল রোহিনীর ছবিটা মেয়েটির হাতে । সূর্য হাত বাড়িয়ে ছবিটা চাইল । মেয়েটি কথা না বলে ছবিটি ফেরৎ দিতে গেল হাত বাড়িয়ে । ছবি না নিয়ে সূর্য তার হাতের কবজি ধরে দিল টান । পাৎলা শরীরটা বিছানার ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল । ঘরের উজ্জ্বল আলোয় তাকে দেখে সূর্য পড়ার টেবিলের দিকে প্রায় ছিটকে পড়ল ভয়ে । মেয়েটি নগ্ন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার তার পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়েছে দুটি সুবৃহৎ নরম পালকাবৃত ডানা । রোহিনীর ছবিখানা মেঝেতে পড়ে রইল । থুঁতনিটা দু’হাঁটুতে ঠেকিয়ে বৃহৎ দুটো ডানাকে জড়িয়ে নিজের নগ্নতা ঢেকে বসে রইল সেই যুবতী । 




সূর্যর কাছে কোনও মেয়েদের পোশাক ছিল না । রোহিনীর যে সমস্ত কাপড়চোপড় ছিল তা সবই কলকাতার বাড়িতে । তবু ভদ্রতার খাতিরে একখানা সাদা চাদর বের করে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেল সে। গতকাল রাতে বাইরের বারান্দার দরজাটা খোলা ছিল , মেয়েটি সেই পথেই ঘরের ভিতরে ঢুকেছে । ভূত ব্যাপারটায় তার আগাগোড়া বিশ্বাস ছিল না । তবে প্রৌঢ় ম্যানেজারের মুখে অনেক আগের একটা ঘটনা শুনেছিল সূর্য । এক সন্তানসম্ভবা তরুণীকে ভর্তি করা হয়েছিল চল্লিশ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে । মেয়েটির প্রসব করা সন্তান রাতের অন্ধকারে চুরি যায় । আবছা চোখে তরুণীটি দেখতে পায় এক নারীর ছায়া দেওয়ালের গায়ে মিলিয়ে গেল । পাশে হাত রেখে দ্যাখে তার বাচ্চাটি নেই । সন্তানশোকে পাগলপ্রায় সেই মেয়ে নদীর জলে ঝাঁপ দিতে যায় একরাত্রে । কিন্তু কোথা থেকে আশ্চর্যভাবে এক যুবতী এসে তার সন্তান ফিরিয়ে দেয় । সেই থেকে রটে যায় নদীর ওপারে জঙ্গলে ভূত থাকে । কেউ কেউ সেটাকে কালীঠাকুরের দর্শন বলেও ধরে নিয়েছে । ঈশ্বর ও শয়তান, দুজনকেই মানুষ ভয় পায়, কেননা তাদের চেহারা দেখতে মানুষ অনভ্যস্ত । ঈশ্বরকে মানুষ ভীতি ও স্বার্থের লোভেই সাধনা করে, অনুসরণ করে । ন্যায্য মানুষ করোর মতাদর্শকে গ্রহণ করে না । কেননা বিবেচনার মাধ্যমেই জীবনের সকল সত্য ফুটে ওঠে । কাউকে অনুসরণ করলে নিজস্ব সত্তার একাংশ তার অনুরাগের কাছে বন্ধক হয়ে যায় । মানুষ সততা থেকে বিচ্যুত হয়ে মনোনীত হয়ে ওঠে । সূর্য এই ব্যাপারে ভাবতে লাগল । প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেছিলেন বটে, ‘তুমি সুপুরুষ , তার ওপরে বিপত্নীক । অবশ্য স্ত্রী যদি বেঁচে থাকতোও , তা হলেও মেয়েমানুষেরা তোমাকে ছেড়ে দিত না । মেয়েরা নারী বিরহে কাতর পুরুষের চেয়ে নারী বিদগ্ধে পীড়িত পুরুষকেই বেশি কামনা করে ।’
কৌতূহল চেপে না রেখেই প্রৌঢ় ম্যানেজারকে সূর্য জিগ্যেস করেছিল, ‘ভূত যদি না হয় তো সেই মানবীটি কে ?’
—‘পরী ।'
—ধুস ! সে তো রূপকথার গল্পে থাকে । বাস্তবে তা হয় নাকি ?
—‘কেন হয় না ? বাতাস ও বিদ্যুৎ যদি অদৃশ্য হয়েও অস্তিত্বময় হয়, তবে পরী কেন নয় ?’
—আর কেউ কি দেখেছে তাকে ?
—‘সকলে ভয় পায় দেখতে । কুৎসিত লোককে মানুষ সহজে দেখতে পায় , সুন্দরকে অহঙ্কার ভেবে বসে । বসে কি না ? খারাপ চরিত্রের ভিতর সৎগুণ লুকিয়ে থাকে , তুমি এ কথা মানো ?’
—মানি । কিন্তু দেখতে চাই সেই পরীকে ।
—‘সে তোমার ভাগ্যে থাকলে দেখা পাবে । তবে সুন্দর জিনিসের স্বভাব বড় উঁচু-নীচু । এ কথা মনে রেখো ।’


ফিরে এসে সূর্য দেখল চাদরটাকে বুকের ওপর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পেঁচিয়ে কেমন সুন্দর ভাবে পরে আছে সে , ডানা দুটি উন্মুক্ত তবে প্রসারিত নয় , তবে গোটানো । আয়নায় হাত রেখে নিজেকে দেখছে সে । যেন ছুঁতে চাইছে নিজস্ব দেহসত্তাকে । সূর্যর উপস্থিতি টের পেয়ে সরে দাঁড়াল । 

কাল রাত্রে দ্বিধা কাটিয়ে ভোরের দিকে সামান্য কথা বলেছে মেয়েটি । অন্ধকারে তার হাতের জাদুলাঠিটা কোথাও পড়ে যায় , সেটা খুঁজতে গিয়ে তিনজন মাতালের খপ্পরে পড়ে । পোশাক সর্বস্ব ছিঁড়ে ফ্যালে তারা । পিঠে ডানার অস্তিত্ব দেখতে পেয়ে ভয়ে তারা পালায় । অন্ধকার বসতির মধ্যে এই বাড়িটিতে একমাত্র আলো জ্বলছে দেখে সে উড়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায় । পরে আলো নিভলে সে ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে , কিন্তু ডানার ঝাপটায় টেবিল থেকে মদের বোতলটা মাটিতে পড়ে যায় । তারপরের ঘটনাটা সূর্য নিজে প্রত্যক্ষ করেছে । দিনের আলোতে সে বাইরে বেরুতে পারবে না । কিন্তু রাত নামলেই ফিরে যাবে জঙ্গলে । 




মানুষ প্রত্যাশিতকে কামনা করে , কিন্তু ভালবাসে অপ্রত্যাশিতকে । যে মানুষকে অামরা আশায় গেঁথে রাখি , তার থেকে বঞ্চনা ছাড়া কিছুই পাই না । অথচ যে হৃদয় থেকে সত্যের সহজ বার্তা আসে, আমাদের মন সেই হৃদয়ের প্রতি চিরকালই জীবনবিমুখ । সেই আশ্চর্য নারী, যাকে আর পাঁচটা মানুষ ভয় পায়, কিংবা দেখতে উৎসুক, সূর্য তাকে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না । তবে কিছুদিন নিজের ঘরেই সংকোচে জীবনযাপন করতে লাগল । কোনও বাড়িতে যখন নতুন কোনও মেয়ে প্রবেশ করে , তখন সে নিজেকে অত্যন্ত সংকোচের মধ্যে বেঁধে রাখে । ধীরে ধীরে তা আলগা হয়ে আসে । নতুন গৃহে রমণী যখন পুরনো হয়ে নিজেকে মেলে ধরে , তখন নিজেরই বাড়িতে এতদিনকার প্রসারিত পুরুষটির জীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে । পুরুষমানুষের এই দ্বিধা মেয়েদের চোখে পড়ে বটে, কিন্তু মনে ধরে না । তেমনই সূর্য এখন নিজের ঘরে ঢুকতে গেলে দরজায় টোকা মারে । বিছানায় পাশাপাশি শুতে তার সংকোচ বোধ হয় । তার মনের মধ্যে মাঝেমাঝে চিন্তা আসে মেয়েটির শরীর কি ছদ্মবেশে আসা রোহিনীরই শরীর ? শুধু তাই নয় , বেশ কিছু সর্বনাশের ছায়া নেমে আসে সূর্যর বুকে , আজকাল মেয়েটির মুখও নিঃশব্দে হানা দেয় স্বপ্নে । সে যেন তার দু’হাতের সরু আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে সূর্যর জামার কলার । নীল চোখ দিয়ে চেয়ে আছে সূর্যর চোখের দিকে , তার ঠোঁট দুটো জানান দিচ্ছে পাপের ইশারা । সূর্যের ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে ,পাশ ফিরে মুখোমুখি হয়ে দ্যাখে মেয়েটি চেয়ে আছে তারই দিকে। এই পারস্পরিক লজ্জা ভাঙার জন্য সে মেয়েটির নাম রেখেছে নন্দিতা । 
—তুমি ঘুমাওনি ?
—‘না, প্রহর গুনছি !’
—কেন ? আমি তো তোমাকে তাড়িয়ে দিইনি ।
—‘তা বলে কি আমায় ফিরে যেতে হবে না ? আমার লোকেরা আমাকে নিতে আসবে কোজাগরী পূর্ণিমায় ।’
—তারা তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল বুঝি ?
—‘হ্যাঁ , তবে তারা ফেরৎ আসবে ।’
—আমি যদি যেতে না দিই তোমাকে ?
—‘তারা কেমন করে শুনবে তোমার কথা ? আর তোমার পৃথিবীর মানুষ আমাকে মানবে কেমন করে ?’
—আমি বিদ্রোহ করব মনুষ্যজাতির সঙ্গে । লড়াই চালাবো নিজের ভিতরে । তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে ?
—‘পরীদের চিরদিনই কষ্ট । তাদের সৌন্দর্য শাপগ্রস্ত । তবে তুমি আমাকে কষ্ট দাওনি । তোমাকে হারালে এ কদিনের স্মৃতি হয়তো সেটা দিতে পারে ।’
—হ্যাঁ , ঠিকই বলেছ । প্রবৃত্তি মানুষকে ভিতর থেকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয় । কিন্তু সংকোচ আর লোকলজ্জা তাকে বাইরে বেরুতে দেয় না । এ দুটো জিনিস মানুষকে অন্ধকারে ঠেসে ধরে ।
— ‘সেদিন যে মেয়েটির ছবি আপনি দেখছিলেন , তিনি কে ?’
—আমার স্ত্রী, রোহিনী ! বছর দু’য়েক হল সে মারা গিয়েছে । 
—‘ভালবাসতেন বুঝি ?’
—জানি না । সহবাস করতাম, তারপর একরকম মায়া পড়ে গিয়েছিল । আমি তাকে ত্যাগ করতে পারিনি । তবু সে বেঁচে থাকুক সেটাই চেয়েছিলাম । কিন্তু আমি যে গ্রহণও করতে পারিনি , সেটা সে বুঝতেই পারেনি । আজ মনে হয় , আমি তাকে দাম্পত্যে যথেষ্ট সুখ দিয়েছি ,কিন্তু ভালবাসায় অত্যন্ত ঠকিয়েছি । তার কাছে ক্ষমা চাইবার কোনও মুখ নেই আমার । 
সূর্য টের পেল ডানার নরম পালক তাকে স্পর্শ করেছে । সেই স্পর্শে কোনও উদ্বেগ নেই, আশ্রয় আছে । সে নন্দিতাকে জিগ্যেস করল, তুমি বুঝি বাচ্চা চুরি করেছিলে ?
—‘হ্যাঁ । শিশুদের প্রতি পরীদের মাতৃত্বের লোভ থাকে ।’
—তা হলে ফেরৎ দিতে এলে কেন ?
—‘আমাদের দুনিয়ায় মানবশিশু কীভাবে বেড়ে উঠবে ?’
সে রাতের পর থেকে সূর্যের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা সংকোচের হিমস্রোত নেমে গেল । মনে হল বাড়িতে কাউকে রেখে সে খনির কাজে চলে যায় । ফেরৎ আসবার তাগিদ এখন তার আগের চাইতে বেশি । নন্দিতার তবু সংকোচ কাটে না । সূর্যের মনের তলায় বারবার ছিপ ফেলে সে জিগ্যেস করে তাকে কেমন দেখতে লাগছে ? ডানা দুটো কেটে দিলে কি তাকে সূর্যর প্রয়াত স্ত্রীয়ের চেয়েও সুন্দরী লাগবে ? সূর্য যে ব্যাগভর্তি করে বাজার করে আনে তা সে উড়ে গিয়ে দু’মিনিটেই আনতে পারবে । একদিন বলেই বসল , ‘আমি তো একদিন চলেই যাব , তুমি এবার অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করে নিচ্ছ না কেন ? স্ত্রী মারা গেছে বলে কতকাল নিঃসঙ্গ থাকবে ?’
এসব কথার উত্তরে সূর্য তাকে থামিয়ে দিত, কিংবা কিছু একটা করে বুঝিয়ে দিত কে তার মনোনীতা পাত্রী । কথার আঘাতে বাড়ি খেলে মেয়েরা যেমন চুপ করে যায়, কিছুকাল এড়িয়ে চলে , তেমনই নন্দিতা দু’একদিন কথা বলত না । কিন্তু মুখ দেখলে বোঝা যেত ,চোখে ভালবাসার বিদ্রোহ জমে আছে, ঘা দিলেই উপচে পড়বে । এমনই দোলাচলে কেটে গেল কিছুমাস, একদিন বিপদ আর নিষ্কৃতি একসঙ্গে এসে দাঁড়াল শিয়রে । স্থানীয়রা কীভাবে টের পেয়ে গেল নন্দিতার উপস্থিতি । বিশ্বাসযোগ্য অতনুবাবুই বিশ্বাসের বন্ধ দরজাটা খুলে দেন সকলের কাছে । স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে  পুলিশ তাকে ধরতে আসে । কিন্তু বিপদ কেটে যায় । নন্দিতার এ কদিন অব্যবহৃত ডানা তাকে পিছনের বারান্দা হতে উড়িয়ে নিয়ে যায় জঙ্গলে । ঘরে ঢুকে পুলিশ খানাতল্লাসি করে সূর্যকে তো দেখতে পায় , কিন্তু নন্দিতার খোঁজ তারা পায় না । যে জায়গায় এতকাল একটা সুনাম অর্জন করেছিল সূর্য , আজ স্থানীয়দের চোখে সেটাই দুর্নামে পরিণত হয়েছে । স্থানীয়রা নন্দিতার ওপর যে শিশুচুরির অভিযোগ এনেছিল , সেটাকেই হাতিয়ার করে সূর্যের নামে যা খুশি রটাচ্ছে । কিন্তু সেসব নিয়ে সূর্যর মাথাব্যাথা নেই । রাজনীতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করা মানুষের ধর্ম । সস্তা জিনিসের জন্য নগদ তাই হাতে হাতে পাওয়া যায় , কিন্তু সততার মূল্য মানুষ দেরিতে বোঝে , একেবারে জীবনের প্রান্তে পৌঁছে । 




আজ সেই কোজাগরী পূর্ণিমার দিন , জঙ্গলের ভিতরে কালীমন্দিরের চাতালে এসে বসে আছে সূর্য । এই জায়গাটার কথাই নন্দিতা বলেছিল । হঠাই পিছনদিক থেকে নরম দুটি ডানা তাকে ঘিরে ধরল । 
—কোথায় ছিলে তুমি ?
—‘মন্দিরের পিছনে , ঐ মস্ত বট গাছটার কোলে । ’
—আজই কি চলে যেতে হবে ?
—‘হবে বৈকি ! তুমি কেমন করে একা থাকবে ?’
—থাকতে পারব । তুমিও তো একা হয়ে যাবে , বাঁচতে পারবে ?
—‘বাঁচতে হবে ।’
—আমার স্বপ্নগুলো চিরকালের মতো আবার ঝরে যাবে ।
—‘যাবে না । আমি রোজ আসব তোমার স্বপ্নে । হানা দিয়ে যাব তোমার একচিলতে বুকে , গভীর রাত্রে । যেমনটা তুমি প্রায় স্বপ্নে দেখতে !’


তেইশ দিন পর ডাকে চিঠি পায় সূর্য ,মায়ের অসুস্থতার চিঠি । সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে কলকাতার ট্রেনে উঠে পড়ে সে । কলকাতায় ফিরে মায়ের চিকিৎসার একটা সুব্যবস্থা করতে হবে । তবে তার আগে কলকাতা অপিসে সে দরখাস্ত দেবে , গ্যাসচেম্বারের প্রোজেক্টে সে আর থাকতে চায় না । মোটের ওপর তার জীবনের সব সম্পর্কগুলো হয় মৃত্যুতে নয় চিরবিচ্ছেদে সম্পন্ন হয়েছে । মানুষের জীবনই তো এক আশ্চর্য রূপকথা , পৃথিবীতে সত্য সর্বদা পরিবর্তনশীল ।  হৃদয়ের আচরণও চিরদিন এক জায়গায় থেমে থাকে না । অপচ্ছন্দের সম্বন্ধ পচ্ছন্দসই হয়ে ওঠে কালের নিয়মে । শুধু এতকাল পরে একটা ব্যাপারই অমীমাংসিত থেকে গেল,— সেদিনকার রাতে দেখা স্বপ্নের কথা তো সে কাউকে কখনও বলেনি , তা হলে নন্দিতা কীভাবে সেই স্বপ্নের কথা জানলো ? স্বপ্ন ভাঙার পর সেই যে তার নীল দু’চোখ , তার মধ্যে শয়তানের এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল সূর্য । ‘শয়তান’ হল মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । রূপকথা যাকে প্রকাশ্যে এনেছে । সাহিত্য যাকে আড়াল করেছে অনেক কথার নীচে । সেই দৃশ্য ফুটে উঠেছিল মেয়েটার চোখে যা রোহিনীর চোখে কোনওদিনও  দেখতে পায়নি সূর্য । 


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম