১
কমলারঙের এক উতল রোদ
গড়িয়ে নামছিল, তার ফ্যাকাসে হলুদ শরীরে। ছড়িয়ে পড়ছিল বিস্ময়। নরম সেই আলোর ভিতরে
ডুবে ছিলাম আমি।
তুড়কি তপোবন আশ্রমের
চৈত্রমেলার সংকীর্তন পেরিয়ে, টেরাকোটা শহর পেরিয়ে, আধফোটা বালক আমি প্রথম
পৌঁছেছিলাম রূপকথার খুব কাছাকাছি।
সে এক গমগমে
রূপকথা।ঝমঝমে অপরূপকথা। এখনকার চুপকথার সঙ্গে একব্রর্ণ মেলানো যাবেনা।
এখন ঝরে পড়া হলুদ
এলামাটি, খসে পড়া পলেস্তরা, আর্দ্র হাওয়ায় খাঁ খাঁ রূপকথার শরীর পায়রা, বাদুড়,
ইঁদুর আর বেড়ালের নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
আমার বালক বয়সে সেখানে
বিকেল থেকেই গান বাজতো। গানের ভিতরে বাজতো বহু মানুষের ফেলে রাখা সময়।
তখন জমজমাট ছিল তার
ভিতরমহল, তার বাহিরমহল। বাহিরমহলের সেই রোদ, এখনো গড়িয়ে পড়ে, আমার অবচেতন মনের
গভীরে।
শৈশব পার হওয়া,
প্রাথমিক ইস্কুলের আমি, যখন মামার সাইকেলে চেপে, অকারণ ঘুরতে ঘোতে ঘুরতে, নানাবিধ
বিস্ময় আবিষ্কার করতে শিখছি, সেরকম হাওয়ার দুপুরে মেলা থেকে অন্য এক রাস্তা ধরে
এসেছিলাম রূপকথার কাছে। ঈষৎ বিকেলে রূপকথার গ্রীবা বেয়ে নেমে আসছিল সেই আশ্চর্য
কমলারঙের রোদ।
আমার গলা বেয়ে, সেদিনই
প্রথম নেমেছিল হঠাৎ অবাক হওয়া ঝাঁঝালো তরল। বোতল থেকে খেতে পালবোনা বলে গেলাসে
ঢেলে আমাকে দিয়েছিল। কোকাকোলা। উফৃ উপর্যুপরী দুই আশ্চর্য ঘটনায় সেদিন যেরকম
ভ্যবলা বুঝভুম্বোল হয়েছিলাম, এখনো, যেন মনে হয়, মাঝেমাঝে সেরকম বিপন্ন বিস্ময়ে
থাকি।
সেই ঝাঁঝ যদিও এখন আর
নেই। সেই রোদ আর নেই। সেই রূপকথাও কি আছে?
কে যেন বলছিলো, রৃপকথা
ভেঙে, সেখানে নাকি শপিং মল তৈরি হবে!!
২
পাঁপড় না কিনে দিলে তো
মেলাই বৃথা। কিনে দেয়নি। শহরের অলিগলি পেরোতে পেরোতে মনখারাপ (দাঁ ) মিইয়ে পড়ছিলো। তারপর
রূপকথা নামের সেই সিনেমাহলের টিফিন স্টলে গিয়ে এই কোল্ডড্রিংকস আর ভেজিটেবল চপ। সেদিনকার
আভিজাত্যের খাওয়া।
সিনেমাহলের বাউন্ডারির
ভিতরে একটা বড়ো গেইট ঠেলে ঢুকেছিলাম। মনে আছে। সারি সারি খাবার স্টল। ইয়া লম্বা
সাইকেল স্ট্যান্ড। লটারির দোকান। হিংয়ের কচুরি। চা। রঙচঙে ঝলমল। হলের বাইরে মাইকে
গান। আর লোকজন লোকজন আর লোকজন।শো চলাকালীনও এত লোক বাইরে থাকতো, এখন কেউ বিশ্বাসই
করবেনা।
হলের ভিতরে পর্দায় কী
ঘটছিলো জানিনা। কিন্তু বাইরেও এত লোক দেখে মনে হচ্ছিল কিছু ঘটছে এখানে। কিছু কি
ঘটেছিলো? এখন যখন আর কিছুই ঘটেনা, মনে হয় ঘটনাটা ঘটেছিল কিছু! নইলে সেই চঞ্চলতা
এখনো মনে আছে কেন?
সেই চঞ্চলতার ঊর্ধে গড়িয়ে
নামছিলো রোদ। এখনো নামছে।
রূপকথায় তো এরকমই হয়।
যখন কিছু ঘটে তখন, কেউ বুঝতেই পারেনা আবার ঘটে যাবার পরে অনেকে বিশ্বাসই করেনা।
৩
ক্লাস সিক্স বোধয়। সে
ছিল এক দিন আমাদের। চ্যারিটিশো'য়ের দিন। চ্যারিটি কাকে বলে ও কয় প্রকার
বোঝিনি।ইস্কুলে বলা হলো, পরশুদিন দু'টাকা করে আনতে হবে, সবাইমিলে সিনেমা দেখতে
যেতে হবে। ক্লাসেই দেওয়া হবে সিনেমার টিকেট। আমাদের প্রাচীন মফঃস্বলে আরো দুটি
সিনেমা হল থাকলেও, আবারও রূপকথা।
হাফডে স্কুলের পর,
সদলবলে, সবান্ধবে, হেঁটে হেঁটে, রাস্তার ধার ঘেঁষে, রূপকথাতেই।
এবার অন্যরূপ। সেরকম
লোকজন, রৈ রৈ নেই ।সিনেমাচত্বরের ঘুম ভাঙেনি তখনও। তবু, প্রথম সিনেমা
দেখা।উত্তেজনায় সিঁড়ি টপকে টপকে লাফিয়ে লাফিয়েই পৌঁছেছিলাম দোতলা বারান্দায়। আরো
এক আশ্চর্য অপেক্ষায় ছিল। একজন অদ্ভুত মানুষ। তাকে আগেও দেখেছি রাস্তায়, সিনেমা
বয়ে নিয়ে যেতে। এবার সেই লোক, এই দুপুরেও টর্চ জ্বেলে আমাকে পৌঁছে দিলো আমার আসনে।
একটু রাগ হয়েছিলো।
আমাকে সে একেবারে পিছনে বসিয়ে গেল? এখান থেকে অনেক ছোটো ছোটো দেখাবে না?!
অনেক সামনে থেকে দেখে,
অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, নিজেকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলাম, হ্যাঁ, এই সেই লোক,
যে, সারা শহরে সিনেমা বয়ে নিয়ে যায়! রাগ পুষে রাখতে পারিনি বেশিক্ষণ।
কী দেখেছিলাম সেদিন?
('আশিকী? ধীরেট্য) চ্যাপলিনের 'মর্ডান টাইমস'? খুব মনে পড়ে খাবার খাওয়ার যন্ত্রটি।
খেতে খেতে নাস্তানাবুদ চ্যাপলিন। আর ঐ (দুহাতঃে দুহাতঃ) দুহাতে রেঞ্জ নিয়ে
নাটবল্টু আঁটা! আর ঐ জলার ধারে কাঠের (সঃ) সেই নড়বড়ে ঘর। আর ঐ জলে ঝাঁপিয়ে
চ্যাপলিনের স্নান?
তখন বুঝিনি, আজ বলি,
আমার জীবনে প্রথম, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সেরা সিনেমাটি দেখেছিলাম রৃপকথাতেই।
এক অপরূপ কথা।
সিনেমা দেখার চেয়েও,
সেদিন অনেক বেশি আশ্চর্য (হয়ঃ) হয়ে দেখেছিলাম, রূপকথার অন্দরমহল। দিনের আলোয় এক
লাবন্যহীন সাদামাটা চেহারা। পর্দার দুপাশে নটরাজ শিবের মূর্তি। মাথার ওপর দিয়ে
ঝটপট পায়রা উড়ে গেল। এখানে আসার সময়, রাস্তায় কে যেন বলছিলো, হলের ভিতরে খুব
ইঁদুরের উৎপাত। সিটে পা তুলে বসতে হয়, নইলে আঙুল খুবলে নিয়ে যাবে!!
চ্যাপলিনের ম্যাজিকের
মতো অভিনয়, তাকে দেখে, সেই হাসির হুল্লোড়ে, সেদিন হাত পা মাথা কোনোকিছুই অবস্থানে
স্থির ছিলো না। এখনও মর্ডান টাইমস দেখলে ঘিলু অস্থির হয়ে (যি) যায়।
সিনেমা শেষে হলের থেকে
বেরিয়ে, সেদিন, ভেজিটেবল চপ খুঁজিনি, কোল্ডড্রিংক্স খুঁজিনি। সেই আশ্চর্য রোদও
খুঁজিনি।খুঁজে পেয়েছিলাম আমাদের অনেকেই চ্যাপলিনের মতো হাঁটবার চেষ্টা করছে!!
ভেবেছিলাম, বাড়ি ফিরে,
জীবনের প্রথম (সিনো) সিনেমা দেখার গল্প বলে মাত করে দেবো! উল্টে আমিই ব্যোমকে
গেলাম। সেদিন নাকি দুপুরবেলাতেই রাত নেমে এসেছিলো!! সবাই সেই রাতদুপুরের গল্প
নিয়েই ব্যস্ত!! এমনকি খেলতে গিয়েও পরদিন বন্ধুদের বলতে পারিনি। সবাই সেই
দিনদুপুরের রাতবিরেতের গল্পই শোনাতে চাইছে।
রূপকথার ভিতরঃরের গল্প
আর বলতে পারিনি। অভিমান হয়েছিলো। দুপুরবেলা সত্যিই কখনো রাত নেমে আসে? (বিশূবাস
বিশ্কবাসরিনি) বিশ্বাস করিনি।
৪
তারপর কী দেখেছিলাম?
বাবা তারকনাথ? মার সাথে? নাকি, ভ্যাবলা পল্টু? নাকি, গুপী গায়েন বাঘা বায়েন?
দ্বিতীয়বার রূপকথায়
প্রবেশ কবে আর কার সঙ্গে, মনে পড়ছে নাতো!! (তবঃ) তবে, বাবা তারকনাথ মনে আছে। মনে
আছে দর্শক কী বিপুল আবেগে পয়সা ছুঁড়েছিল পর্দার দিকে। অনেক দেবস্থানেই দেখেছি এরকম
পয়সা ছুঁড়ে দেয়। দেবতার কি মাঝেমাঝে ভিখিরি হতে ইচ্ছে করবে না??!!
আর সেই গান? আজ তোমার
পরীক্ষা ভগবান। তখন জলে স্থলঃলে অন্তরীক্ষে সর্বত্রই দিবারাত্র এই গান। সিনেমা
পাল্টে গেলেও বাইরের মাইকে এই গান বেজেছিল বহুদিন। ভগবান দীর্ঘদিন পরীক্ষা
দিচ্ছিল!! তুমি পাথর নাকি প্রাণ, ভগবান?
মামাবাড়ি যাওয়া বা অন্য
অনেকক্ষেত্রেই এই রাস্তা আমাকে ব্যবহার করতে হতো। এই রূপকথার সঙ্গে তখন এক মজার
খেলা চলতো আমার।
লতা মুঙ্গেশকরের একটা
গান প্রায়ই বাজতো। "এবার আমি আমার থেকে আমাকে (বাঅং) বাদ দিয়ে/ অনেক কিছোছু
জীবনে যোগ দিলাম/ ছোট্ট যত আপন ছিল বাহির করে দিয়ে/ ভুবনটারে আপন করে নিলাম"।
কোনো কিছু না বুঝেই,
গানটি ভালো লাগতো আমার। (অঃ) এই গান বাজলে আমার হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে যেতো। অতিধীর।
যেন রূপকথার সামনে থেকে সরেই গেলেই গানটি হারিয়ে যেতে পারে। আর তখনই খেলাটা হতো।
যেই একটু দূরে গেছি, অমনি বাতাস তাকে কিছুটা উড়িয়ে নিয়ে অন্য কোথাও রেখে আসতো কিছু
লাইন। সেইসব শব্দ আর সুর আমি ফিরে পেতে চাইতাম। পরেরবার সেগুলি ফিরে আসলেও, হারিয়ে
যেতো অন্য কোনো লাইন।
এভাবেই রৃ রূপকথার
সঙ্গে ফসলবিলাসী হাওয়ায় মাতামাতি ছিলো।
এক সন্ধের রোমাঞ্চকর
অভিজ্ঞতা বলি। রূপকথার ডানপাশের গলিপথ দিয়ে আমরা অঙ্ক পড়তে যেতাম। কোনো এক টিউশন
সন্ধ্যায়, আচমকা জানা গেল, স্যার থাকবেন না সেদিন। ব্যস! সানধ্যকালীন সিনেমাউৎসব।
সদ্য গোঁফ গজানোর চেয়েও
বেশি রোমাঞ্চকর ছিল সেই সিনেমাগমন। কেউ যেন কিচ্ছুটি না জানতে পারে। বাড়িতে জানলে
তো হয়েই গেল। বাড়িতে না জানিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার মধ্যেই যেন যাবতীয় সাবালোকত্ব
প্রাপ্তি।
কী চলছিল? 'আশিকী'?
ধীরে ধীরে প্যায়ার তো বাঢ়ানা হ্যায়?
এবং এই প্রথম একটি
পরিভাষা শিখলাম, 'ব্ল্যাক'!
একসঙ্গে সতেরোটি টিকেট
পাওয়াই মুশকিল। টিকেট কাটতে গিয়ে কারো সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়? যদি বাড়িতে জেনে
যায়?
অতএব ব্ল্যাকে টিকেট
কেনা। লম্বা জুলপি, চুস প্যান্ট আর ব্যাগিহাতা জামা। কব্জিতে স্টিলের চেইন।কলার
ওপরে তোলা। একজন জিগ্যস করলো টিকেট লাগবে, খোকা?
খোকা? সাংঘাতিক রাগ
হচ্ছিল। ওরাও বুঝিয়ে বাজিয়ে সাত টাকার ফার্স্টক্লাস টিকেট বিক্রি করেছিলো পনেরো
টাকায়।বাহ্ বাহ্ ব্ল্যাক শিপ্।
টিউশন কেটে ব্ল্যাকে
সিনেমা। ফলে পলিটব্যুরো মিটিং। ঢুকবো সবার শেষে, বেরোবো সবার আগেই। সিনেমা শেষ হবার
অন্তত আধঘন্টা আগে। সতেরোজনের দলে, একজনের আছে ঘড়ি। তাকে পই পই করে বলা। সে যদি
ভুলে যায়, তার পাশে (যঃ) যে বসবে, তাকেও।
সাইকেল স্ট্যান্ডে
রাখতে হবে সবার শেষে। তাহলে আগে বেরোতে হুল্লোড় হবেনা। হাল্কা সেই শীতেও মাফলার
দিয়ে কান মাথা জড়ানো। কেউ কেউ (কা) নাকমুখও। অতিরিক্ত সতর্কতা। তবু শেষ রক্ষা
হলোনা। সোমনাথদের বাড়িতে সকালবেলা দুধ দিতঃতে যায় যে, সে দেখে ফেলেছে। ফলে
সোমনাথকে আবিষ্কার করলাম সিনেমা শুরুর আধঘন্টা পর!
এদিনই জানলাম যারা
টিকেট ব্র ব্ল্যাক করে, তারা যে বাংলা ভাষায় কথা বলে, সেটি বঙ্গ আমার জননী আমার
নয়। দ্বিগুনের বেশি দাম দিয়ে টিকেট কাটার পরও ওরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছিলো, অপমান
করছিলো। ওরা নাকি রূপকথার 'ডন'! ওদেরকে সবাই ভয় পায়। ওরা যেখানে দাঁড়ায়, সেখান
থেকেই নাকি লাইন শুরু হয়!!
৫
রাস্তা দিয়ে সিনেমা
হেঁটে যায়। মানে সিনেমা পোস্টার। মামাবাড়ির সামনের বড়রাস্তায় আমি বহুবার হাঁটতে
দেখেছি সিনেমা পোস্টার।
আসলে (অন্ত্য) অত্যন্ত
বেঁটে একটি লোক পিঠে বাঁশের চাঁচে পোস্টার সেঁটে হাঁটতো। পিছন থেকে লোকটিকে দেখাই
যেতো না। শুধু তার রঙবেরঙের শঙ্কু টুপিটি উঁচু হয়ে থাকতো। তার হাতে ছিল টিনের
চোঙা। এই চোঙামুখে সে অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে ঘোষণা করতো সিনেমার নাম। সিনেমা যাই
হোক, পরিচিতি দিতো একটাই। এক সে সুর : নাচে গানে ফাইটিঙে মন মাতানো সাদাকালো
হিন্দি বাংলা ছায়াছবি। ডিস্কো ড্যান্সারই হোক বা (গো) গুরুদক্ষিণা। কয়ামত সে কয়ামত
তক হোক বা অমরসঙ্গী।
তাকে দেখার জন্যই
রাস্তার দুপাশে লোক দাঁড়িয়ে যেতো।শহরে আমোদও তখন কম ছিলো। এই আশ্চর্য বামনাবতার
ছোটো ছোটো দুটি পায়ে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবদি রটিয়ে বেড়াতো, রূপকথায়
নতুন কী এলো!!
এই 'গ্যাঁড়াদা'কে নিয়ে
মজার একটি ঘটনা শোনেছিলাম।সম্ভবত বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমা চলাকালীন নাকি সপ্তাহ
শেষের বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়েছিল, অদ্যই শেষ রজনী। তবু সিনেমা পাল্টায়নি। পরের
বৃহস্পতিবারও একই ঘোষণা করলো, অদ্যই শেষ রজনী। জোসনা তবু গেল না। তার পরের
সপ্তাহেও গেলনা। তখন, কে নাকি বলেছিল, "বেদের মেয়ে এখন যাবেনা। তুমি জানোই
না। শুধুশুধু শেষ রজনী শেষ রজনী বলো কেন?"
এই গ্যাঁড়াদা তখন আরো
জোরে চিৎকার করতে করতে বলেছিলো,"অদ্যই নির্ঘাত (শঃ) শেষ, নির্ঘাত শেষ,
নির্ঘাত শেষ রজনী, দেখে নিবে"!!
তারপরও বেদের মেয়ে
জোসনা (আর) চলেছিল প্রায় ছ'মাস!!
এই গ্যাঁড়া (বেঁটে
লোককে এ অঞ্চলে গ্যাঁড়াই বলে)দা'ই সেই আশ্চর্য মানুষ, ক্লাস সিক্সে প্রথম সিনেমা
দেখতে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম।এই সেই লোক যে আমাকে রূপকথার ভিতরে আলোর রাস্তা
দিয়ে চিনিয়ে দিয়েছিলো আমার অবসাস্থান।
লোকটিকে শেষ দেখেছিলাম,
হাইস্কুল মোড়ের বড়ো অশ্বত্থ গাছের তলায়। গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসেছিলো, একা।
মাথা নীচু। সেদিন কোনো পোস্টার ছিলনা। কোনো ঘোষণা ছিলনা। শুধু শূন্যবাতাস ছুঁয়ে
গাছ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছিলো পাতা। সে ছিল নির্বাক। বসে।
চিত্রার্পিত এই
দৃশ্যটিকে সিনেমা পোস্টার মনে হয়। এখনো রূপকথার মতো লাগে।
৬
যে রূপকথার গ্রীবা বেয়ে
গড়িয়ে নামতো নরম কমলা রোদ্দুর। যে রূপকথার আসপাশে নানান ছলছুতোয় ঘুরঘুর করেছি, সেই
রূপকথাকেও এড়িয়ে যেতে লাগলাম। সামনে দিয়ে তো (নয়ি) নয়ই, আসপাশের কোনো রাস্তা দিয়েই
যেতামনা তখন।
যখন, বেদের মেয়ে জোসনা
এসেছে। অনেক বন্ধুরাই বলতে লাগলো, রূপকথাও দূষিত হয়ে গেল!!
মাইকে সারাক্ষণই, বেদের
মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে! উফ্। সহ্য হতো না। মেনে নিতে পারতাম না। তবু উপচে পড়া
ভিড়। কেউ কেউ পনেরোবার পর্যন্ত নাকি দেখেছে।
আমি দেখতে যাইনি। দেখতে
চাইনি। এই আকস্মিক বদলে গোপনে আঘাত পেয়েছি। এই বদল মানতে পারিনি। আমার রুচিতে
বেঁধেছে। এক বন্ধু বলেছিলো, রুচি ধুয়ে জল খাবে নাকি? পাবলিক এখন এরকমই চাইছে।
ব্যবসাটা তো চালাতে হবে।
চললো না তো!! রূপকথা
এরকম বিষাদগৃহ হলো কী করে? নির্জন নিঃসঙ্গতা নিয়ে একা হয়ে আছে। সংস্কৃতিকে 'পাবলিক
ডিমান্ড' অনুযায়ী চালাতে গিয়ে, টিকে থাকার লড়াইয়ে (ব্বসা ) ব্যবসা করতে গিয়ে
কীভাবে ধ্বংস হতে হয়, এক একটি এরকম সিনেমাহল দেখলেই বুঝতে পারা যায়।
ভারতীয় সংস্কৃতির (পা)
ফল্গুপ্রবাহে যে রুচি আবহমান, তার ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে, তাকে কদর্য করে
পরিবেশন করলে থাকেনা কিছুই।
চিরন্তন নৈতিক প্রবাহে
সবই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়।
এখন শুনি এই হল ভেঙে
শপিংমল বানানো হবে। ভালোই। কেনাবেচার হাট গোগ্রাসে খাক। খাক করে দিক প্রাণের আরাম।
শতজল ঝর্ণার স্রোত যেরকম বোতল বোতল কিনি, সেরকমই না হয় বসন্তবাতাসও এই শপিংমলে
সিলিন্ডার ভরে (কিনে) নিয়ে যাবো। তখনও কোনো রূপকথার বামনাবতার পোস্টারে প্রচার
করবে, "লে লে বাবু ছে আনা"!!
৭
সাত।
এক বৃষ্টিসন্ধ্যায়,
মাথা বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছি রূপকথার নীচতলায়, গোল বারান্দায়। আমি এবং কয়েকজন। বাইরে
অঝোর নামলো জোরে। খানিক পরে (দোটি) দুটি হলুদ বাল্ব জ্বলে উঠলো।
চুপচাপ দেখতে থাকলাম,
রূপকথার ক্ষয়ে যাওয়া অঙ্গের নিভৃতি নির্মাণ। বড়ো আর উঁচু আর মোটা চুন সুরকির থাম।
মোটা মোটা কড়ি বরগায় ঢালা টালি ইঁটের ছাদ। পুরোনো ঢঙের দালান।
এসব দেখতে গিয়েই
অকস্মাৎ মনে হলো, আচ্ছা, এই রাত্রে, একবারের জন্য যদি রূপকথা তার পুরোনো রূপ ফিরে
পায়!! জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মতো অহংকারী লাগছিল রূপকথার আনাচ কানাচ।
এই ভাবনার কিছুদিনের
মধ্যেই দেখি, সত্যি সত্যি রূপ ফেরানো হচ্ছে। রঙ করা চলছে। ঝোপজঙ্গল,ময়লা, ঝুল
সরিয়ে টরিয়ে আবার আগের রূপ ফেরানো চলছে। ভীষণ অবাক হয়ে খোঁজ নিতে গেলাম, আবার
সিনেমা চলবে নাকি?
জানলাম, সিনেমা দেখানোর
পরিবর্তে কৌশিক গাঙ্গুলির নতুন ছবি ' সিনেমাওলা'র শুটিং শুরু হবে। পুলক চিনচিন
করলো। সত্যি সত্যি রূপকথা না থাক, স্মৃতি অন্তত বিনষ্ট হবে না পুরোপুরি।
নতুন কোনো রূপকথা
সৃষ্টি না হলেও, অবশিষ্ট সামান্য স্মৃতি সংরক্ষিত থাক।
শুধু ঐ অসামান্য আলো,
নরম কমলারঙের রোদ, আর কেউ কোনোদিনই দেখতে পাবেনা, গড়িয়ে পড়ছে রূপকথার উজ্জ্বল
শ্যামবর্ণ গ্রীবা বেয়ে।
No comments:
Post a Comment