Saturday, December 15, 2018

সবর্না চট্টোপাধ্যায় -- সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি যে আসলে আমাদেরই হাতে থাকে…







বাক্সটা খুলে গেল আচমকা। বেরিয়ে এলো ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাক। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে জ্বলজ্যান্ত ছেলেবেলা। এ কোনও গল্প নয়।
চোখের সামনে দেখি একটু একটু করে বেড়ে উঠছে আমারই শৈশব। দৌড়ে বেড়াচ্ছে একটা সাদা ছাগলছানা যেন যাদুছড়ি ঘোড়ালেই ডানা মেলে উঠবে যাদুকরী ভাসিলিসা। কি তার রূপ কি তার রঙ!
বাবা ইয়াগার লম্বা ঠ্যাং ছড়ানো দৃশ্যের কল্পনা করেনি এমন ছেলেবেলা সত্যিই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অদ্ভুত এই দেশ, রূপকথা। যার পরতে পরতে শুধু ভালোলাগার চমক। অশুভ বিনাশে শুভ চিন্তার জয়। এ পাওয়া তো শৈশবের চরম পাওয়া। যখন মন শুধু সাদা রঙটাই চেনে, অন্ধকার বোঝে না। 
রূপকথা বলতে প্রথমে যা চিনেছিলাম তা হল  রুশদেশের উপকথা। তারপর ঠাকুমার ঝুলি, বিক্রমবেতাল, জাতক, ঈশপের গল্পমালা। জগতটা যেন ছিল লালকমল নীলকমলের। বিপদে পড়লে জুটে যেত ঠিক ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী। দুনিয়ার রাক্ষস খোক্ষস দত্যি দানবের দল লুটিয়ে পড়ত যাদুতলোয়ারের কোপে। পরিবারের ভাইবোনরা ছিলাম তখন যেন অরুণ বরুণ কিরণমালার মতন। শুয়োরাণী আর দুয়োরাণীর গল্প না শুনলে ঘুম আসত না একসময়। তারপর স্বপ্নে আসত সিভকা বুর্কা। তাগড়াই চিকনাই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চুল্লীর তাকে শুয়ে থাকা ছাই মাখা খুদে ইভান চলে যেত সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। সে কি কখনও দেখেছিল আরব্য রজনীর সেই অপরূপা শাহরাযাদকে? কখনও কি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল দৈতাকার সেই রকপাখি? ভাবতে ভাবতে কেমন বড় হয়ে গেল রূপকথারাও। তাদের দেশে ফুল ফুটলে তখন বলে উঠতাম সে তো ফেলে আসা শৈশবের দিন। তবে রূপকথাদের হয়ত সত্যিই বয়স বাড়ে না। বাড়ে আমাদের। তাইতো যখন ফিরে পেলাম জে কে রাউলিং এর হ্যারিপর্টারকে খুদে দর্শকদের সাথে সিনেমাহলে ছুটে গেল যুবক কিশোর বৃদ্ধের দল। হ্যাগওয়ার্ডের রাজকীয় রহস্যঘন দরজা খুলে যাচ্ছে একে একে আর রূপকথার যাদুর ঘোরে ডুবে যাচ্ছে আমাদের বয়স। ঝাড়ুতে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অমর শৈশব। এই পর্টার সিরিজ ঝড় তুলেছিলো সেসময়। মনে হত, এইবুঝি দরজা খুললেই সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে বাজপাখি হাতে সেই বিশালাকার হ্যাগ্রিড। এমনকি স্কুলের হেডমাস্টার বা হেডমিস্ট্রেস বলতে কল্পনা করতাম ডাম্বেলডোরকে। 

দক্ষিনারঞ্জন মিত্র মহাশয়, প্রথম, ময়ানমার থেকে সংগৃহীত রূপকথার ভিত্তিতে সংকলিত করলেন ঠাকুমার ঝুলি। সাল ১৯০৬। ভূমিকা লিখলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। তেমনই শাক্যমুনি বুদ্ধের পূর্বজন্মের কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছিল জাতকের কথা। আবার খরগোস ও কচ্ছপের গল্পের মতো আরও অনেক নীতিমূলক গল্প সংকলিত আছে ঈশপের গল্পমালায়। এই ঈশপ ছিলেন গ্রীস দেশের লোক। দেখতে কদাকার ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান। লোকমুখে প্রচলিত তার গল্পগুলোই তার মৃত্যুর পর সংকলিত করেন গ্রীসের দার্শনিক জিমট্রিয়াস। আরব্য রজনীর গল্পগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার। ইসলামিয় স্বর্ণযুগে আরবিতে লেখা গল্পের সংকলন হল এই আরব্য রজনীর গল্প বা এরবিয়ান নাইটস। পারস্যের রাজা ও তার নব বধূকে ঘিরে রচিত হয়েছে এর প্রেক্ষাপট। নিজের স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা রাজাকে তীব্র নারীবিদ্বেষী করে তোলে। তিনি কুমারী মেয়েদের একে একে বিবাহ করেন ও বিবাহের প্রথমরাতেই হত্যা করেন তাদের। অবশেষে তার উজিরের মেয়ে শাহরাযাদকে বিবাহ করলে, শাহরাযাদ তাকে রোজ একটি করে গল্প বলতেন ও গল্পগুলি শেষ করতেন না। এভাবে মোট ১০০১ টি গল্প বলতে বলতে রাজাকে আগ্রহী করে তোলেন পরের গল্পের জন্য ও তার মৃত্যুদন্ডও বিলম্বিত হতে থাকে। এভাবেই রচিত হয় আরব্য রজনী। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাগদাদ শহর।মনি মানিক্য। বড়বড় বানিজ্য জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে তীরে। তৈরী হচ্ছে বণিকদল আর অসীম সহসী সেই সিন্দাবাদ। কি অদ্ভুত জগত ছিল সেসব।
এ প্রসঙ্গে চাইলেও বাদ দেওয়া যাবে না যে সত্যিটা সেটা বলা যায় আজও যেন একটা স্বপ্ন। মিথ বললেও ভুল হয়না । বন্দী রাজকন্যা রূপানজেলের চুল ধরে উঠে আসা সেই স্বপ্নের রাজকুমার কিংবা সেই রূপবান যুবক যে সিনড্রেলার পায়ে পরিয়ে দেয় হারানো একপাটি জুতো। তুষারকন্যা ও সাতবামুনের গল্পেও যেন দেখতে পাই হুবহু এক সেই রাজপুত্রকে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দেশী বিদেশী কল্পনায় মিশে যায় স্বপ্নে দেখা রাজপুত্রের মুখ যে পক্ষ্খীরাজে সওয়ার হয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় তার রাজকন্যাকে। সেই অসীম সাহসী বলশালী রূপবান  প্রকৃতার্থে কোন রূপকথা নয়,যেন আনাচে কানাচে বড় হওয়া এক বাস্তব। এখুনি হাওয়ার গতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত কষ্ট।তেমনই এক স্বপ্নপুরুষ হয়ে ওঠে হ্যারি। হ্যারি পর্টার সিরিজ আসার পর তোলপাড় পড়ে যায় বাজারে। বেস্টসেলার তকমা নিয়ে এই রূপকথাও হয়ে ওঠে কঠিন বাস্তব।
রূপকথা কিন্তু গড়ে ওঠে বাস্তব থেকেই। ছোটবড় নানান ঘটনার সাথে কল্পনা, ভালোবাসা, রঙ মিশিয়ে তৈরী হয় তার নিজের জগত। লালপরী, নীল পরীদের মতো কত কত দৈত্যি দানব ডাইনির আর্বিভাব সে দুনিয়ায়। আজও কি কম এই রাক্ষসদের উৎপাত?  শহর যখন উত্তাল হয়ে ওঠে অসামাজিক কার্যকলাপে তখন কোথাও কি মনে হয় না একবারও কোথায় গেল সেই মিরাক্যাল টাচ্ যার ছোঁয়ায় সব দুষ্টুলোক জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে যেত? কোথায় আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ? 

কতবার হয়েছে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখা হয়েছে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর সাথে। শত দারিদ্র্যের মধ্যেও যারা একে অপরকে জড়িয়ে বেঁচে থাকে,  হাসি ফোটায় অন্যের মুখে। তাদের ম্যাজিক টাচে খুশি হয়ে যায় মন। খানিকটা আমাদের পাড়ায় গরম সাদা রুটি আর কষাডিম বিক্রি করা এক দম্পতির মতো। ক্লান্তির পৃথিবীতে একপলশা বৃষ্টি। মুখে দিলে মিলিয়ে যাওয়া মায়ের আদর। কিংবা সেই সিনড্রেলা কি সেই মেয়েটা নয় যাকে রোজ ধূপ বিক্রি করতে দেখি এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে? আসলে রূপকথা গুলো রোজ হেঁটে বেড়ায় আমাদের সামনে। যেন ব্যাঙের খোলস পড়া যাদুকরী ভাসিলিসা। আমাদের জীবনীশক্তিও বলা যায়। ক্লান্ত কর্মব্যস্ত জীবন হোক বা ভারাক্রান্ত বার্দ্ধক্য রূপকথা কয়েকফোঁটা শান্তির জল। এর সত্যতা স্বীকার করেই বহুদিন হল দেশে বিদেশে চালু হয়েছে স্টোরি টেলিং থেরাপি। যা মানুষকে অবসাদ ও চাপ মুক্ত করতে সাহায্য করে। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড বা বৃদ্ধাশ্রমে এই ধরনের প্রয়াস চালানো হয়। আমাদের দেশে ব্যাঙ্গালুরুর গীতা রামানুজম হোক বা চেন্নাইয়ের এরিক মিলার তাদের পথ অনুসরণ করে পিছিয়ে নেই শহর কলকাতাও। স্টোরি টেলিং কে পেশা করে আজকের একাকীত্বের শৈশবকে তারা রঙিন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। যে শৈশবে আজ হারিয়ে যাচ্ছে পরিবার। ঠাকুমা দিদিমার মুখে সারাদুপুর জেগে জেগে গল্প শোনা।
একটু বড় হওয়ার পর ফিল করি আমার কাছে আবার রূপকথা হল প্রথম টিভিতে দেখা সোনারকেল্লা। ট্রেন থেকে দেখা সোনালী আলোয় মোড়া রহস্যকিলা। কেল্লার ভেতরে পা রাখা মাত্র মনে হয়েছিল, এখানেই তো দৌড়ে গিয়েছিল মুকুল। সেই সিঁড়ি যার সামনে এসে দাঁড়াবে এখুনি একটা ময়ূর। আর সেই দুষ্টুলোক? দুষ্টুলোক না হলে তো রূপকথা হয়না। শেষ যেবার জয়সালমিরের এই ফোর্টে গেছি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি মুকুলের পূর্বজন্মের খুঁটিনাটি। ভাবতে অবাক লাগে, সে জন্ম কি আমারও ছিল না? তবে কেন এত টান? ছটফটানি? কিভাবে বাস্তব আর কল্পনা মিশে যায় জলের মতো। ফোর্টের ভেতর ঠিকরে পড়ছে চাঁদ। হাতের কাজের পসরা সাজিয়ে বসে আছে লোকাল জনতা বিক্রির জন্য। এক একটা কাঁথায় কি অপূর্ব কাজ। সত্যিই যেন সোনার সুতোর ফুল তোলা আলাদীনের সেই যাদু কার্পেট।
শুধু চোখ কান খোলা রাখা আর মাঝে মাঝে শৈশব ঘুরে দেখা। রূপকথারা কাছে আসতে বাধ্য। সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি যে আসলে আমাদেরই হাতে থাকে….চাইলে ঠিক খুঁজে আনা যায় দুষ্টু দৈত্যের প্রাণভ্রমরা।




No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম