১
আমার জন্মের অনেক আগে ঠাকুরদা মারা যায়।ঠাকুমাও
চলে যায়,আমি তখন সবে দুই কি তিন বছরের।মামা বাড়ির
দাদু-দিদাও ছিল না।তাই,ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই একটি মুখ খালি মনে পড়ে।মায়ের এক
দূর সম্পর্কের কাকিমার কথা।শীতকাল এলেই তার গন্ধ আমি টের পাই।সেইসব অন্ধকার,
পাড়াগাঁর শীতরাত আমি অনুভব করি দু'চোখের পাতায়।তাই, মামা বাড়ির এক মাত্র আকর্ষণ
ছিল
মায়ের সেই কাকিমা।নাম মনোকালী।খুব ঠাণ্ডা,হাসিখুশি
প্রকৃতির সদাচারী মানুষ ছিল সে।আমাদের
সব ভাইদের আগলে
রাখত। রাতে শুতে যাবার সময় আমাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হত।কে দিদার একেবারে পাশটিতে
শোবে।কখনও কখনও আমার শিকে ছিঁড়ত সে সুযোগ।
দিদার গন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে।পান-জর্দা-খয়ের এর গন্ধ
যেন এখনও ভেসে বেড়ায় আমার চারিদিকে।দিদার প্রতি আকর্ষণের মূল কারণ ছিল গল্পবলা।সে
সব গল্পের বীজ যে কোথা থেকে সে জোগাড় করত জানি না,তবে অসাধারণ ছিল সে গল্প বলার
স্টাইল।লেপের ভিতরে সারা শরীরটা
ঢুকিয়ে দিয়ে শুধু মাথাটা বের করে শুনতাম সে সব গল্প।
সেকি গল্প না পাড়াগাঁর সত্যি ঘটনা?জানতাম না।তবে
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেইসব গল্প যেন এক রূপকথার রাজ্যে আমাকে নিয়ে যেত।
পুরনো দিনের দোতালা মাটির বাড়ি।খড়ের ছাওয়া চাল।দোতালায়
হাতের তৈরি কাঁথায় আমরা শুতাম।খড়ের চালের সিলিং এর দিকে নজর যেত।মনে হত এই বুঝি
চাল
ফুঁড়ে ঢুকে পড়বে হাতে খড়্গ নিয়ে দাদারি ডাকাত।ভুতুড়া
গ্রামে নাকি মায়ের এক পিসিমার বাড়িতে সে ডাকাতি করেছিল।তার নাম শুনলেই আশ-পাশের
সব গ্রাম ভয়ে
কুঁকড়ে যেত।চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে আসত সে।অনেক পরে
শোলের গব্বর সিং কে দেখে মনে মনে দাদারি ডাকাতের
কথা মনে পড়ত।
তা সেই দিদার মুখে শোনা গল্প-গাথাগুলো আমার ছোটবেলায় এক
জগৎ তৈরি করে দিয়েছিল।একা একা হাঁটলে আজও মনের কোথাও যেন সেই গা ছম্ ছম্ ভাব
জাগে।একদিনের কথা আজও মনে পড়ে।দিদার সঙ্গে আমরা সবাই শুতে
গেছি।আমি,দাদা,টুটুল,প্রণব,রিঙ্কু---সব্বাই।দিদা বলল,আজ আর ভালো লাগছে না।কাল
তোদের একটা গল্প বলব।আমরা তো নাছোড়।জোড়াজুড়িতে দিদা অগত্যা রাজি হল।সেদিন থুড়ি
সেরাতে দিদা শুনিয়েছিল ঘোষ বাড়িতে ভুতনামার কিসসা।আমরা সবাই
লেপের ভিতরে উত্তেজনায় ফুটছিলাম।ঘোষবাড়ির মেজ বউ কে
শাঁকচুন্নিতে ধরেছে।আর সারাদিন বউ বিড় বিড় করে কী সব বলে চলেছে।কখনও গান গাইছে
খনা গলায়।কখনও বা
মন্ত্র আওড়াচ্ছে।আর শুধু শাপ-শাপান্ত করছে
শাশুড়িকে,শ্বশুরকে।তা তখনও পর্যন্ত এক চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স বাকী ছিল।আমাদের
চুম্বকের মতো টেনে রেখেছে সে ঘটনা।
দিদা বলে চলেছে,
তখন প্রায় মাঝ রাত।ঘোষবাড়ির
সবাই যে-যার বিছানায় শুয়ে পড়েছে।হঠাৎ একটা বিড়ালের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ছোট
দেওর,তমালের।চোখ কোচলে,মাথা তুলে দেখে
একটা সাদা বেড়াল প্রাচীর টোপকে ব্যানার্জীদের বাড়ির
ওদিকে চলে গেল।কিন্তু হঠাৎ ওদিকে চোখ যেতেই আটকে গেল চোখ।হুড়মুড়িয়ে উঠে
পড়ল।চাদর-টাদর ছুঁড়ে ফেলে
দেখে,বাড়ির পশ্চিম কোণের যে নগুড়ে কুল গাছাটা,তার ডাল
থেকে একটা মানুষ ঝুলছে।কাছে যেতে সাহস পেলনা
তমাল।সে কি চিৎকার করবে?ডাকবে সকলকে?মনে মনে
ভাবে।অন্ধকারে
ঠিক চিনতে
পারা যাচ্ছে না।সাহস করে বারান্দা থেকে উঠোনের লাইটটা জ্বালতেই সে অবাক।কই কিছু
নেই তো।
অথচ সে স্পষ্ট দেখল একজন কুলগাছ থেকে ঝুলছে। লাইটটা আর
বন্ধ করেনি সে।সকালে গ্রাম থেকে দু-মাইল দূরে দেরেপুরের কালীবাড়ির পাশে জাম গাছে
ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছিল মেজ বউকে।মুখে এক প্রশান্তির হাসি লেগেছিল!
শীতের রাতে একলা কোনো গাছের দিকে তাকালে এখনও সেই
গল্পটার কথা (সত্য ঘটনা !)মনে পড়ে।দিদার মুখে শোনা সব গল্পই যেন সত্যি মনে হত।
সে যাইহোক,কিন্তু ওই গল্পকথাগুলোই আমার মনের ভিতরে এক
কল্পরাজ্য গড়ে তুলেছিল সেই ছোটবেলায়।যা আমার কাছে আজও সাত রাজা ধন মানিকের
মতো।আমি কল্পনা করতে শিখেছি।চোখ বন্ধ করলে জাদুদণ্ড যেন ছুঁয়ে যেত আমার মস্তিষ্ক
।সে জগৎ এমন এক জগৎ যা আমাকে সমস্ত প্রতিকূলতা,দুঃখ-যন্ত্রণার
মুর্হুতেও বাঁচিয়ে রাখেছে।
২
একটু যখন বড় হলাম,যখন বাড়িতে টি,ভি এলো।স্যালোরা
কোম্পানি।সাদা-কালো।আর এক মায়ার জগৎ এ ঢুকে পড়া
গেল।আলিফ-লৈইলা।সিনদেবাদ জাহাজীর কত রকম অভিযান।অন্যদিকে
বিক্রম-বেতাল।পঞ্চতন্ত্র।কী সুন্দর এক কল্পনার দেশে পৌঁছে যেতাম মনে মনে।প্রতিরাতে
আমি স্বপ্ন
দেখতাম। উত্তাল সমুদ্রে আমি পাড়ি দিচ্ছি।হাতে শামসেরা
সুলেমানি তলোয়ার।একের পর এক ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে আমার জাহাজ।সেই আরব্য
কাহিনির চুম্বক আমাকে টেনে রাখত।মাথার ভিতরে এক স্বপ্নরাজ্য গড়ে তুলেছিল সে
অভিজ্ঞতা।
এইসব স্মৃতি ছোটবেলায় আমাদের এক মায়াবী জগৎএ নিয়ে
গেছিল।তার সঙ্গে মায়ের মুখে শোনা বিভিন্ন ব্রতকথা,তার পাত্র-পাত্রী --আর এক জগৎএ
নিয়ে যেত।এইসব নিয়েই তো আমাদের হ'য়ে ওঠা।আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখা।আমরা ও আমাদের
পরের ভাইবোনেরা মনে হয় শেষ প্রজন্ম,যারা এই মায়ার জগৎ,রূপকথার জগৎ সরাসরি
দাদু-ঠাকুমাদের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি।এরপর তো বিশ্বায়নের স্রোত, আধুনিক
সুযোগ-সুবিধার জোয়ারে আর নিউক্লিয়ার ফ্যামেলি, ফ্ল্যাট কালচারের দাপটে রূপকথারা
শুধুই বই এর পাতায় বন্দী হ'য়ে থাকল।ঠাকুমা-দাদুরাও টি,ভি র
সিরিয়াল ,রিয়েলিটি শো ইত্যাদিতে এতে ব্যস্ত হ'য়ে পড়ল যে তাদের মাথাও আজ
রূপকথাহীন,সাংসারিক ঝগড়া-ঝাটিতে পূর্ণ।নাতি-নাতনিরাও সারাদিন সারারাত হোমওর্য়াক
আর কোচিং এর জালে জড়িয়ে পড়েছে।চুরি গেছে তাদের বাল্যকাল।আর যেটুকু সময় পাওয়া যায়
সেটুকুও অধিকার করেছে মোবাইল,ইউটিউব।মায়াবী জগৎ আর কোথায়?সব জায়গাতেই আলো পড়ে
গেছে।কল্পনার কুহক যেন কোথাও অবশিষ্ট নেই।বইপত্র পড়াশুনাও উঠে যাচ্ছে।পড়লেও
বিদেশী ভাষার বিদেশী রূপকথা।নিজের ভাষায় ,নিজের দেশের রূপকথা যতটা হজম হবে,ততটা কি
অন্য দেশের গল্পকথা রক্তে মিশবে?নতুন প্রজন্মের মা,-বাবারা এই অসাধ্য সাধনের
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।সোনার পাথরবাটির কথা এ প্রসঙ্গ মনে আসে।ফলে যা হওয়ার তাই
হচ্ছে।কল্পনাশক্তিবিহীন, ডেটাসর্বস্ব এক যন্ত্র-প্রজন্ম এসে গেছে আমাদের
পৃথিবীতে।যারা কল্পনা করতে পারে না।শুধু ডেটা
খোঁজে।'রূপকথার জগৎ' তাই তাদের কাছে এক অবাস্তব,
এঁদো,অপ্রয়োজনীয় জগৎ।যার কোনও মূল্য নেই তাদের কাছে।
এ এক ভয়ঙ্কর সময়।সভ্যতার
ভবিষ্যৎ যেসমস্ত নতুন ছেলে-মেয়েদের হাতে,তারা ক্রমশ যান্ত্রিক হ'য়ে পড়ছে।মানবিক
দিকগুলো,মুল্যবোধগুলো লোপ পাচ্ছে তাদের মধ্যে।এক যান্ত্রিক,হৃদয়হীন সভ্যতার দিকে
এগিয়ে চলেছে গোটা পৃথিবী।যেখানে মানুষ শুধু সংখ্যামাত্র।মানুষ শুধু ছোট্ট একটা
ক্লিকের দাস!!
No comments:
Post a Comment