Thursday, December 13, 2018

আলোচনা- রিমি মুৎসুদ্দি




বারুদ বারুদ গন্ধে যেন বৃষ্টি শব্দ আর মনে পড়ে যাওয়া সোঁদাগন্ধের নস্টালজিয়ায় ছিটকে এসে লাগা কোনো বিভ্রম




গ্রন্থ- পাগল আষাঢ় ডাকাত শ্রাবণ’, অংশুমান কর
প্রচ্ছদ- সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল্য-১৫০ টাকা


ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখেছিলাম- The calm sound of rain and the sudden gunshot. একটানা বৃষ্টির যখন খুব অভাব সেইসময় হাতে তুলে নেওয়া কবিতার বই কবি অংশুমান করের ‘পাগল আষাঢ় ডাকাত শ্রাবণ’, কিছুটা হেমন্তে কিছুটা শীতের প্রথমবেলায় পড়তে পড়তে বৃষ্টির শব্দের মধ্যে মাঝেমাঝে একটা গানফায়ারের ঘ্রাণ এসে মিশেছে। বড় চেনা সে গন্ধ। কিন্তু কবে কোথায় পেয়েছি তাকে মনে করতে পারি না। মনে করতে পারি না ডাকাত আর যুদ্ধের মধ্যে কোনও কোরিলেশন আদৌ আছে কিনা? হয়ত বা অবচেতনে চেনা শব্দগুলোর মধ্যে না থাকা শব্দও মুখ বাড়ায়। মুখের কথায় বইটির মেঘ সিরিজের একটা কবিতার কথা মনে এল-
১লা আষাঢ় আসলে
১৮ বছরের প্রেমিকের কাছে
প্রথম বকা খাওয়ার পর
১৬ বছরের
থমথমে মুখ...
আহা! টিন এজ প্রেম মনে পড়ে গেল। কিন্তু যাদের টিন এজ প্রেম নেই? তাদের জন্য অবশ্যই আছে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানগুলো সবকটা প্রেমপর্যায় হয়ত নয়। যেকটা মনে আসছে এই মুহুর্তে শ্রাবণের বিদ্যুতের মতোই ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যাওয়া পুরনো কোনও প্রেমের গল্প অথবা সিনেমা।

বর্ষা আসলে যমজ দু-ভাই
পাগল আষাঢ় ডাকাত শ্রাবণ’- বিভাব কবিতা
বইটি উৎসর্গে লেখা আছে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান। পুরো বইটা তিনটে কবিতা বা তিনটে সিরিজ কবিতার সমন্বয়। মেঘ, বৃষ্টি, বারুদ। বারুদ শুনলেই মণিপুরের কবি ইবমচা সিং-এর স্বপ্নকবিতার গানফায়ারের কথা মনে পড়ে যায়। পাকা আঙুরের মতো যার স্বাদ।
বৃষ্টির কবিতায় খিচুরি আর মাছভাজার গন্ধ কী অদ্ভুতভাবে প্রেম আর বিচ্ছু ছেলেদের দস্যিপানার সাথে মিশে যায়।
একা একা পুরস্কার নেওয়ার বদলে
তারা দল বেঁধে গাড়ি চালিয়ে
দিগন্ত পেরিয়ে
চলে গেল দিঘা।
এরপর ওরা বিচ্ছু ছেলেদের মতো
একসঙ্গে বসে খিচুড়ি আর মাছভাজা খাবে।
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা সান্ত্বনা
কোনো পুরস্কারই ওরা চায় না
শুধু
তুমুল বৃষ্টির দিনে, নীপবনে, ওগো সেকেন্ড ইয়ার অনার্সের রাধারানি,
বিপদে পড়লে- ওরাই বাঁচাবে।
সবথেকে ঘৃণা যাকে করে ফেলে মানুষ কখনও ত্রাতার ভূমিকায় পাওয়া যায় হয়ত তাকেই। এবস্ট্রাক্ট নয় জীবন ছেঁচে তুলে আনা দর্শন অথবা সত্য।

মেঘ সিরিজের কবিতাগুলো নস্টালজিয়া। কবিতা আর নস্টালজিয়া খুব পরিচিত হলেও এখনও হারিয়ে যাওয়া বা বলা ভাল অবলুপ্ত হওয়া অনেক কিছুই সত্যিকারের অবলুপ্ত হয়েছে। স্মৃতিতেও যারা নেই অথচ থাকার কথা ছিল তারা এসে বসে রয়েছে সমস্ত ‘...ভুলে যাওয়া গানে
স্মৃতির কথায় মিলান কুন্দেরার The Book of Laughter and Forgetting-এর একটা লাইন মনে পড়ে গেল। খুব পচ্ছন্দের তাই কোট করি প্রায়শই। ‘The struggle of man against power is the struggle of memory against forgetting.’ বিস্মরণের স্মরণ ঘটানোর জন্যই যা কিছু আয়োজন।
মেঘ কবিতার কিছু অংশ তুলে দিই বিষয়টা বোঝানোর জন্য-
‘মোটা চশমায় ঢাকা দুই চোখ, চুল ছিল কালো, কোঁকড়া
সমঝে চলত বাবা-কাকা-জেঠু, পাড়ার উটকো লোকরা…
হারিয়ে গিয়েছে সেই ছেলেগুলো, হেরেছে সুদূর, শব্দ
হোয়াটস অ্যাপের খুটখুট দিয়ে চিঠিকে করেছে জব্দ।
প্রেমিক রয়েছে হাজার হাজার, অযুত নিযুত লক্ষ
তিনবুড়ো বলে, ফিশফিশ করে, একজনও নেই যক্ষ।’
কী হারিয়ে গেছে? কিছু কি ক্যামেরার ফিলমে বন্দী ছিল? ছিল না। অথচ ছিল সেইসব মাস্তান যুবকেরা। যারা যক্ষের মতো পাহাড়া দিত পাড়ার সুন্দরী মেয়েটিকে। হয়ত ভালবাসত বলে। বিমল করের ‘দেওয়াল’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ল। অথবা সমরেশ বসুর প্রজাপতি উপন্যাসের শিখা আর সুখেনের কথা। কবিতার মধ্যে উপন্যাস ঢুকে যাওয়া কি অনুচিত? উইলিয়াম ফকনারের প্যারিস রিভিউয়ের সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, কবিতা লেখায় ব্যর্থ হয়ে তিনি উপন্যাস লেখেন। একজন ব্যর্থ কবি শেষপর্যন্ত সফল একটা উপন্যাস লেখেন। একথা ঠিক কিনা তা অবশ্যই যুক্তিতর্কের বিষয়। আপাতত মেঘ, বৃষ্টি, বারুদ ঘিরে গল্পেরা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরা ফিরে ফিরে আসছে। মেঘ কবিতার আরও একটা উদাহরণ পর্যালোচনা করা যাক।
‘তখন মাসখানেক আগেই হলুদ পোস্টকার্ডে খবর দিয়ে
যেদিন বলতেন ঠিক সেদিনই হাজির হতেন রাঙাজেঠু।
থাকতেন মাসদুয়েক।’
রাঙাজেঠু, ফুলমাসি, লালদিদা এরা কি এখনও আর আসে? খবর না দিয়ে আসা দূর এদের আসার খবরও কি আর কখনও কোনো গৃহীজীবনে আসবে? গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ ঠিকানা হারানো, সময় ভুলে যাওয়া মেঘকেও কবি সেই হারিয়ে যাওয়া অতিথিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
‘ওগো মেঘ, এই যে একেবারে দিনক্ষণ মেপে
এবার
পয়লা আষাঢ় তুমি এলে
তুমিই কি বাঙালির সেই হারিয়ে যাওয়া রাঙাজেঠু?’

হারিয়ে যাওয়া সেই মেঘ হঠাৎ করে দিনক্ষণ মেপে চলে এলে সে যেন মনে করিয়ে দেয় আরও অনেক বেদনা, ভয় ও ক্ষত। তাই পরবর্তী অংশে-
‘মেয়ের কপালে দেওয়া টিপ থেকে উঠে এলে বুঝি?
চিলাপাতা জঙ্গলের গাছের গুঁড়ির নীচে ছিলে?
ছিলে ভয়ে? বেদনায়? রাতজাগা চোখের তলায়?
আর কেউ নয়, শুধু ঝিম ধরা দুপুরটি জানে
চুপ করে শুয়ে ছিলে হেমন্তের ভুলে যাওয়া গানে…’

মেঘ, বৃষ্টি, বারুদ যেন কখনও
‘রাগ, ভয়, লজ্জা, প্রেম, ঝুঁকি ও সাহস
সে কি কিছু বোঝে নাকি? আছে তার মন?
বর্ষা, প্রকৃতির কাছে, শুধুই পুরুষ,
ভ্রূণ, নতুন জীবন!’
হয়ত এই জীবনের ভেতরে যেকথাগুলো লেখা থাকবে তারই কল্পনা ফুটে ওঠেছে তাঁর লেখায়-
‘তাদের কোনোটার ভেতর রাগ
কোনোটার ভেতর অভিমান
কোনোটার ভেতর কান্না
কোনোটার ভেতর কথা নেই, কান্না নেই, অভিমান নেই
                                            শুধুই নীরবতা
যেন বজ্র, বিদ্যুৎ, ভারী ও হাল্কা বৃষ্টি, মেঘ ও কুয়াশা
সকলেই বর্ষার কবিতা।’
কবিতা তো আসলে ‘নতুন জীবন’। অক্ষর ধুলোর পুরু স্তর বেয়ে উঠে আসা দীপ্যমান আলো যাকে হয়ত জীবানন্দের কবিতায় খুঁজে পাওয়া প্রেম অথবা ভ্রমণের মতো অভিযাত্রী প্রাণের টিকে থাকের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ভাবা যেতেই পারে।    

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম