আরও আবিষ্কার হোক ভবতোষ শতপথীর কবিতা
ভবতোষ শতপথী। নামটা
অনেকের কাছেই আজও অপরিচিত। মেদিনীপুরের এই কবি মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করে গেছেন
কবিতা নিয়ে, আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। তবু এক আশ্চর্য নীরবতা তাঁকে ঘিরে।
এখনও। একটা শেকড় গাঁথা হয় জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই। জন্মভূমির প্রতি তৈরি হয় একটি
অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কেউ কেউ এই শেকড়ের টানকে উপেক্ষা করতে পারেন সহজেই; পাড়ি জমান
নাগরিকতার দিকে। ভোগবিলাস সম্বলিত এক পরিবর্তনের দিকে। আবার কেউ কেউ সারাজীবন
শুধুমাত্র জন্মভূমিকে ভালোবেসে, অজস্র উপেক্ষা কষ্ট বঞ্চনার কাহিনি বহন করে;
নিঃশ্বাস নেওয়ার মত করে এই মাটিজন্মকে আকড়ে পড়ে থাকেন। আরও বিস্তৃতভাবে ভালোবাসেন।
আবিষ্কার করেন। নিজেকে একাত্ম করে মিলিয়ে নেন মাঠ ঘাটে সবুজ প্রান্তরে। আর জন্ম
ভূমির প্রতি টানটা শুধু পরিবেশের প্রতি থাকে না; মানুষ-জন; পশু-পাখি সবাই এই
ভালোলাগার অংশীদার হয়। সেখানকার ভাষা, কথা, দুঃখবোধ সব যেন তার। ঝাড়গ্রাম জেলার
জঙ্গলমহলকে ভালোবেসে কবি ভবতোষ শতপথী ছিলেন এই রকম একজন মানুষ। নিজের শত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা;
দুঃখকষ্ট উপেক্ষা করে তিনি কাঁদতেন লোধা, শবর, মাহাত, চাষাদের জন্য। নিজে ব্রাহ্মণ
জমিদার বংশের ছেলে হয়েও এখানকার মানুষজনের সঙ্গে হতে পেরেছিলেন এক মন; এক আত্মা।
ব্রাহ্মন্যবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের সঙ্গে একপাতে বসে ভাগ করে নিতে পেরেছিলেন তাদের বঞ্চনার
অভিযোগগুলিকে। নিজে জমিদার বংশের সন্তান হয়েও শাসক গোষ্ঠীর প্রতি আঙুল তুলেছেন।
বিশাল জমিদারি হারিয়েছেন। বিলিয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন দুখী মানুষকে, তাঁর জমি-জমা।
আবার বহু জমি-জমা দখল হয়ে গেছে কিন্তু তিনি তাঁর স্বভাবের জন্য কারও কাছ থেকে ফেরত
চাননি কিছুই। নাকি গরীব ভূমিজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে পেরেছেন! তাদের দুঃখ
কষ্টের কথা তো তাঁর জানা। এই দুঃখের কারণও জানেন। কিন্তু উপায় তো নেই। একমাত্র কলম
ছাড়া। তাঁর লেখনীর কালো রঙ ছাড়া। আজ এই আগ্রাসী যুগে, শুধু মানুষকে ভালোবেসে তাঁর
লেখনী বলতে পারে
'বেশ করেছি সব বেচেছি
বাঁচার তাগিদে/ শেষ সম্বল ভালোবাসা/ বেচবো নগদে/ টিপ দিয়েছি, সই করছি/ দুপিঠ দলিলে/ জানিয়ে
সেলাম সামিল হলাম/ মস্ত মিছিলে'
আসল নাম ছিল ভবতারণ।
পরে ভবতোষ শতপথী। ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনি থানার টুলিবড় গ্রামের বর্ধিষ্ণু জমিদার
পরিবারে, ১৩৪১ বঙ্গাব্দের ২৪ বৈশাখ তাঁর জন্ম। গ্রাম, গ্রাম্য পরিবেশ, গ্রামের
মানুষদের নিয়েই ছিল তাঁর পথচলা। সাহিত্য রচনা। ব্রাহ্মন পরিবারের সন্তান হয়েও,
তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে দলিত বঞ্চিত মানুষগুলোর কথা। তাদের হাহাকারগুলিকেই কবি শান
দিয়ে তৈরি করেছেন তাঁর সাহিত্যক্ষেত্র। তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে সমাজের গভীর
ক্ষতে। শৈশব থেকেই গ্রাম্যজীবনের দারিদ্র্যতা, অনাহার, কঠোর পরিশ্রম, শাসক গোষ্ঠীর
অন্যায়-অবিচার তাঁকে ব্যথিত করেছে। তিনি চিৎকার করে উঠেছেন। আর ফলস্বরূপ, তিনি হয়ে
পড়েন জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে।
প্রথাগত শিক্ষার প্রতি
ভবতোষ শতপথীর তীব্র অনীহা। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করতে পারেননি। ঝাঁপিয়ে পড়েন
সাহিত্য চর্চার প্রতি। দলিত মানুষের সঙ্গে তৈরি হয় তাঁর আত্মীয়তার বন্ধন। শেখেন
তাদের ভাষা। আরও বোহেমিয়ান জীবন। বাঁধন না মানা নিয়মে চলে তাঁর জীবনধারা। বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হলে ছেলের সংসারে মন বসবে ভেবে, পিতা শ্রীপতি শতপথী, গায়ত্রী দেবীকে
পুত্রবধূ করে আনেন। কবি তখন সদ্য যুবক। কিন্তু এই বিবাহ সুখের হয়নি। কবিকে বাঁধা
যায়নি। তিনি আরও বেশি করে যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছেন। হৃদয় ভরে উঠছে
মানুষের কান্নার স্রোতে। এর মাঝেই চলছে সাহিত্যচর্যা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
প্রকাশিত হচ্ছে কবির কবিতা। স্বাধীনতা, বসুন্ধরা, দৈনিক সমাচার, নন্দন, কৃত্তিবাস
ইত্যাদি পত্রিকা কবি ভবতোষ শতপথীকে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের দরবারে সম্মুখীন করছে
তখন। আর তিনি কবিতার সঙ্গে ঘুরে বেড়ান লোধা, শবর, মাহাত, চাষাদের সঙ্গে। লেখেন
তাদের গান। সভ্য সমাজের কাছে পৌঁছে দেন জঙ্গলমহলের বঞ্চিতরূপটিকে। হৃদয় কাঁদে ওদের
জন্য। ওদের দুঃখের কথা, বঞ্চনার কথা ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। জমিদারি মেজাজের
আত্মীয়স্বজনদের কাছে তিনি তখন হয়ে পড়েন 'বেজাত'। ততদিনে নামমাত্র দামে তাঁর সমস্ত
সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে। আর তখনই দারিদ্র্যের সঙ্গে শুরু হয়েছে
কবির বসবাস। আর এই দারিদ্র্যতাই কবির কলমকে করে তুলছে শানিত তরবারি।
1986 সালে কবি একটি
পত্রিকা বের করেন। পইন্যা। জামবনি থানা এবং ঝাড়গ্রামের বিরাট জনসমাজ কুর্মি সম্প্রদায়ের
কাছে পৌঁছে দিতে জ্ঞানের আলো; ভাষার মাহাত্ম্য; সচেতনতা জাগিয়ে তোলার জন্য।
সাহিত্যকে তাদের ঘরের বিষয় করে তোলার জন্য কবি আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখেন। যাতে
এইসব জনজাতি সহজেই বুঝতে পারে। কবিতা লেখেন সুবর্ণরেখা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের
কথ্যভাষা সুবর্ণরৈখিক ভাষায়। রচনা করেন অসংখ্য ঝুমুর গান। রোজকার জীবনের দুঃখ, দারিদ্র,
কষ্ট, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা উঠে আসে তাঁর গানে কবিতায়। "শোচনীয় শালবনে
আলু-থালু টিলার আড়ালে/ লোধা ললনার কন্ঠে,-- ক্ষুধিত দিনের পদাবলি। মাথায় কাঠের
বোঝা, নবজাত শিশুটি আঁচলে" । ঝাড়গ্রামের রুখা-শুখা প্রান্তরের কথা তাঁর
কবিতায় ফুটে ওঠে। তাঁর 'অরণ্যের কাব্য' বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এল ঝাড়গ্রামের প্রকৃত
পরিচয়। মানুষের দীর্ণ-শীর্ণ মুখগুলির কথা। প্রকাশ পেল এক দুর্দশাগ্রস্থ কবির
দীর্ঘশ্বাসও। এই দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার মানুষের মুখে তখন " এমন ঘরে
জন্ম দিলি কেন আমার মা!/ সারাটা রাত জল পড়ছে; পাতা নড়ছে না।"
দুঃখ কষ্ট বঞ্চনা
মানুষের নিত্য সঙ্গী। কিন্তু এই দুঃখ যে সমাজের সৃষ্টি। কবি বুঝতে পারেন। ঝাঁপিয়ে
পড়েন বিদ্রোহে। আগেই প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছেন বোবা মুখেদের। চিৎকার করে বলেন
" ভুখাদের কবি নই, নিজেই জনৈক ভুখা লোক,/ পুণ্য শ্লোক লিখি নাই, ছানি পড়া তিন
নম্বর চোখ/ উবে গ্যাছে ভাববাদ, অনন্ত অভাবে পরাজয়/ শূন্য পাকস্থবলীতেই ঢুকে যায়
বিমুগ্ধ হৃদয়।"
কবি দেখেন শ্রেনী শোষন,
শ্রেণী বিন্যাস-- দেশের মানুষেরাই খাচ্ছে দেশের মানুষের রক্ত। শকুনের চোখের মত
লোলুপ তাদের দৃষ্টি। খুবলে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত অসহায় মানুষকে। কবি চিৎকার করে ওঠেন।
কিন্তু সেই ডাক থামিয়ে দেওয়া হয় মাঝপথে। রাজনৈতিক নেতারা কবিকে ভেবে নেন দলের
সম্পত্তি। কবিকে নিয়ে চলে রাজনীতির খেলা। কবি অসহায়। দারিদ্র্যের লাঞ্ছনা, পেটের
খিদে তাঁকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। কিন্তু কবিতা তাকে থামতে দেয়নি। তিনি তাঁর কলমকে
হাতিয়ার করেন। বুকের রক্ত ঘাম জল মিশিয়ে লেখেন " স্বদেশের সংবিধানে, ইতর,
তস্কর,ছোটো জাত/ রান্নাঘরে চুরি করে চুপি চুপি খায় ফেন ভাত/ প্রহারের ভয়-ডর করেনা
পেটের তাড়নায়/ চোখা চোর কেটে পড়ে; ভুখা চোর ধরা পড়ে যায়।"
কবি ভবতোষ শতপথী ছিলেন
সামগ্রিকতার কবি। তাঁকে আঞ্চলিক কবির গণ্ডীতে বেঁধে রাখা ঠিক নয়। মার্কসবাদী এই
কবি দুঃখহীন অসাম্যহীন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে গেছেন সবসময়ই। জনসচেতনতা জাগিয়ে
তুলেছেন। ঝাড়খণ্ড বিদ্রোহের স্লোগান হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা। লোকের মুখে মুখে ঘুরে
কবিতার লাইন। ঝুমুর শিল্পীরা তাঁর গানকে বেছে নেন প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে।
তিনিও তখন ঝাড়খণ্ড সংগ্রামের জন্য রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা; ঝুমুর গান। কবির
রচনায় ঝুমুর শিল্পী বিজয় মাহাত গেয়ে উঠেন " হে ঝাড়খণ্ডী তুমিও মানুষ বিংশ
শতাব্দীর/ গ্লানি অপমানে গর্জে উঠুক তোমার হাতের তির/ ক্ষুব্ধ আবেগে জুড়ে দাও ছিলা/
লাগাও ধনুকে টান/ মৃত্যুর চেয়ে আরও জ্বালাময় মানুষের অপমান" । চারপাশের
বোবামুখগুলি খুঁজে পায় ভাষা। কবির ভাষাই হয়ে ওঠে আমাদের ভাষা। গান বাঁধে। বিভিন্ন
আঞ্চলিক কবিরাও অনুপ্রাণিত হয়ে ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের কবিতা; গান; শ্লোগান লেখেন। কবি
ভবতোষ লেখেন--" ঝাড়খণ্ডী রে ঝাড়খণ্ডী তর ঘর কত দূরে রে/ বিহার বেঙ্গল ওড়িশার
কিনারে কিনারে"। তাঁকে লোককবির আখ্যা দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে ঝাড়খণ্ড আন্দোলন
স্তিমিত হয়ে পড়ে। কবিও রাজনৈতিক চাতুরি বুঝতে না পেরে ভাগ হয়ে যান। নিজের অজান্তে
কবি তখন শাসক দলের লোক। কিন্তু কবির জায়গা তো জনগনের হৃদয়ে। জঙ্গলমহলের মনে। সেখান
থেকে তাঁকে সরাবে কে! ঝাড়গ্রামের পথে ঘাটে রিক্সাচালকের গলায়, টোটো চালকের হর্ণে
তাই কবির কবিতা বেজে ওঠে। শাল পাতার ঝরা শব্দে বেজে ওঠে তাঁর ঝুমুর গীত।
প্রথাগত শিক্ষার অভাব
তাঁর রচনায় কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। দুঃখ বোধ তাঁকে কাবু করতে পারেনি। দারিদ্র্য,
দুঃখ কষ্ট, বঞ্চনা তাঁর কলমকে আরও শানিত করেছে। তিনি বিশ্বভারতীর অনুমতি নিয়ে চণ্ডালিকা অনুবাদ
করেন কুরমালি ভাষায়। ১৯৯৫ সালের মে মাসে কলকাতার রবীন্দ্র সদনে মঞ্চস্থ হয়
এই অনুবাদিত চণ্ডালিকা। হাত দেন গীতগোবিন্দ অনুবাদের কাজে। কবি বুঝতে পারেন এই
অনুবাদ সম্পূর্ণ করতে হলে চাই বিরাট শব্দ ভাণ্ডার; যা এই আঞ্চলিক কুরমালি ভাষাতে
নেই। তাই তাঁকে এই কাজ অসম্পূর্ণ রাখতে হয়। কবি পরাজয় মানেন না; কবিরা কোনও রকম
হেরে যাওয়াকে সায় দেন না। কবি ভবতোষ শতপথী দারিদ্র্যতা দূরে সরিয়ে তাঁর নিজের জীবন
সম্পর্কে বলেন- "সুখের মুখে ছাই দিয়েছি/ দুঃখের দায় ভাগ;/ এই জীবনের প্রতি
আমার/ অন্য অনুরাগ"।
১৯৯২ থেকে পেয়ে আসা
কবির সামান্য পেনশন, কোনও অজ্ঞাত কারণবশত, বন্ধ হয়ে যায় ২০১২ সালে। চরম দারিদ্রতা কবিকে
অসহায় করে তোলে। বিভিন্ন মানুষ কবির জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু আমানির অভাব
কি মেটে তাতে? মঞ্চে কোনও পুরস্কার দিতে চাইলে, কবি বলে উঠতেন এসবের বদলে যদি কিছু
টাকার ব্যবস্থা করা যায়। কারণ ক্ষিদে যে বড় নিষ্ঠুর; নির্মম। ততদিনে রাঁচি বিশ্বাবিদ্যালয়ের
পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে কবির কাব্যগ্রন্থ। মেদিনীপুর কলেজেও পড়ানো হচ্ছে কবির
কবিতা। জঙ্গলমহলের অসম্ভব জনপ্রিয় কবি ভবতোষ শতপথী ২০১৭ র জানুয়ারিতে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন। বহুদিন আগে এই বাংলার একজন কবি দাবি করেছিলেন, দুধভাতের কথা। একুশ
শতকে এসেও এক কবিকে চাইতে হয় নুন, আমানির কথা। এরচেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! কবি
ভবতোষ শতপথী বাসকে দাকা অর্থাৎ বাসিভাতের অধিকার ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে
অচেনা এক পথে যাত্রা করেন।
আজ স্বাধীনতা লাভের
এতদিন পরেও দলিতদের অধিকার পাওয়ার জন্য লড়াই করতে হয়। আজও সমাজ থেকে; মানুষের মন
থেকে বর্ণ ভেদ প্রথা মুছে যায়নি। এমনকি আলাদা ভাষা, ধর্ম ইত্যাদির জন্য খণ্ড খণ্ড করা হয় রাজ্যের
সীমানা। কিন্তু আশির দশকের সাধারণ এক কবি, প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না
হয়েও, নাগরিক ভাবনায় দীক্ষিত না হয়েও বলতে পেরেছিলেন, " অসভ্যের সভাকবি
মানিনা নিষিদ্ধ কালাকাল/ ব্রাহ্মনের পৈতা ছিঁড়ে হাহাকারে হয়েছি চণ্ডাল/ বেদাবেদ,
ভেদাভেদ,বিসর্জন দিয়ে সিন্ধুজলে/ মুন্ডিত মস্তকে শেষে মিশে গেছি দরিদ্রের
দলে।" আর এখানেই কবি ভবতোষ শতপথীর প্রাসঙ্গিকতা। কবি শুধু তাঁর কবিতার ভাষায়
নয়; কর্মেও এই ভেদাভেদকে মুছে দিতে পেরেছিলেন। একটা বিস্তারিত অঞ্চলের মানুষের
দৈনন্দিন জীবনের রূপকথা লিখেছেন তিনি--- তাঁর কবিতা কথা বলেছে জঙ্গলমহলের কুড়মালি,
সুবর্ণরৈখিক, ঝাড়খণ্ডী ভাষায়, এইসব অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-সুখ, কষ্ট অনুভবের মাধ্যম
হিসেবে। সহজিয়া ভাষার সাধক তিনি। তাঁর সমগ্র কাব্য-সাধনাই ছিল এলাকার দলিত বঞ্চিত
মানুষগুলোর কথা নিয়ে; কষ্ট নিয়ে। আর এখানেই তিনি সামগ্রিকতার কবি। কিন্তু নাগরিক
নন বলে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে, এই কবি, সারাজীবন উপেক্ষিত থেকে গেলেন। থেকে গেলেন
একটা বঞ্চনার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলায় কবি ভবতোষ শতপথী
স্মৃতিরক্ষা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এই কমিটি কবির সমস্ত লেখালিখি; সাক্ষাৎকার;
হাজার খানেক ঝুমুর গীতি-- এক মলাটে বন্দি করতে কৃতসংকল্প হয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা
এই কাজে অনেকটাই এগিয়ে "ভবতোষ রচনা সমগ্র" প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় খণ্ডেরও কাজ চলছে। কোনও তথাকথিত পুরস্কার নয়, লক্ষ লক্ষ সম্পত্তির মালিক নয়-- একজন কবির ওখানেই
সার্থকতা, যখন মানুষ তাঁকে হৃদয় থেকে বরণ করে নিতে পারে। আর ঝাড়গ্রামের রুক্ষ লাল
মাটি, সাঁওতাল ,কুর্মী, চাষা, লোধা সব সম্প্রদায় মানুষের হৃদয়ের আসনে কবি ভবতোষ
শতপথী জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন তাদের ঘরের কবি; লোককবি।
No comments:
Post a Comment