Saturday, December 15, 2018

সুন্দরম রু - সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি






সোনার কাঠি রূপোর কাঠি

ঘুম কী? সে কোন মায়ামৃগ? কোন অলীক প্রাণী! তোমরা দেখেছ কেউ? মায়া মরীচের পেছনে ছুটতে ছুটতে বেলা পড়ে এলোমাঝরাত পার হয়ে গিয়েছে। পক্ষীশাবক জেগে উঠেছে খিদেয়। ঐ শোনা যায় তাদের ক্ষুধার্ত রব। চোখ জ্বালা করছে তোমার। কিন্তু ঘুম কৈ! 'ঘুম আর মোমিনপুরের মাঝামাঝি একটুকরো বারান্দা রয়েছে'তা আর তোমার উজানো হলো না।

ঘুম। মেঘ ছোঁয়া স্টেশনের হদিশ তুমি জানো না। পথ উঠে গেছে পুঞ্জে। তোমার ঘুম আসেনা। ঘুমের সঙ্গে আড়ি।

ঘুমোলে তোমার চোখ অর্ধেক খোলা থাকে, আবিষ্কার করে আতঙ্কিত হয়েছিল সিস্টার। ভেবেছিল সেঁটে গেছি! একুশের কালো মেয়েটি, নাক থ্যাবড়া, পুরু ঠোঁট, অক্সিজেন মাস্ক খুলতে তোমার মুখে ঝুঁকেছিল। চেতনা আসছে ক্রমে। অপারেশন টেবিল থেকে রবারক্লথ বেডে...

ঘুম কোন দেশ? ঘুম কী? সেসবের উত্তর যার কাছে রাখা, এখন দূরত্ব বিস্তর। অথবা খুব-ই নিকটে... লিখেছিলে দুহাজার এগারো'র এমন সময়ে। তখন সদ্য ঘুম চিনছো। ৩১৫৩৬০০০ সেকেন্ড পর, ঘুম। তখন তিনি মিনিবুক দিয়েছেন। ফেরৎ দাওনি। তখন বুকের গন্ধ মিহি নরম, স্বর্ণচাঁপা। তখন ঘুম, পোষা বেড়াল।

ঘুম আসবে, তাই তুমি রাত জেগে আছ?



সুয়োরানী দুয়োরানী

কলিকাতার পূব জলাভূমিতে তখন উড়ে আসছে ভিনদেশী পাখি। তোমাদের আলাপ হলো। প্রথম পরিচয়ে পা-ই বা মচকেছিল কেন? সেই কি ছিল পূর্বাভাস? আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে; বিকেলে মেঘগর্ভ আকাশ, সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বর্ষণ। কী পেয়েছিল সে তোমার অগোছালো কবিতার খাতায়? আদৌ সেসব কবিতা ছিল? নাকি কেবলই প্রলাপ! ক্লাস শেষ হলে তোমরা দুটিতে যেতে ঢালুপাড় ঝিলের ধারে। যেখানে কলিকাতার সব বর্জ্য-তরল এসে জমা পড়ছে। এবং অদ্ভুত এক ইকোলজির খেলায় হয়ে উঠছে পরিস্রুত পানীয়। তোমরা তো এই হতে চেয়েছিলে। বিষ থেকে অমৃত। পারলে আর কৈ!

জল কি নরম? জল কি সরল? কেমন সে রেখা সুবরণ নদী? একটা একটা কবিতার পাতা পুড়ছে। অক্ষর পুড়ছে। মড়া পোড়া গন্ধ উঠছে ছন্দের শরীর থেকে। শব্দের গা থেকে মাংস খসে যাচ্ছে ক্রমে। কেন লিখেছিলে ঐসব কবিতা? নিজেকে প্রশ্ন করলে, জানো, উত্তর আসবে না। নদী তো বয়ে যাওয়ার জন্যই। বাঁক বদলেই কবির অস্তিত্ব, যেমন নদীরও। তাঁর হাতে বাঁধানো মুধুবনী ডায়রির ভাঁজে চেপ্টে আছে বাসি গোলাপ, সুতীব্র কাঁটাসহ।

তোমাদের এক-একখানা হলুদ-নীল দুপুর ছিল। তোমরা পা রাখলে ময়দানে, ছায়া ঘনাতো। পড়ন্ত বিকেলে, ভিক্টোরিয়ার দিক থেকে যে তেরছা রোদ পড়ত তোমাদের অপার্থিব কায়ায়; তাঁর ছায়া হয়ে ওঠা ছাড়া তোমার আর কিছুই হওয়ার ছিল না।

কেমন ছিল তোমাদের দশ’ই সেপ্টেম্বর দুহাজার এগারো? মনে করতে পারো দুপুর একটা ছাপ্পান্ন মিনিট চুয়াল্লিশ সেকেন্ড? পারো কি? নিশ্চিত পারো না। কেউ পারে? তোমাদের স্মৃতিকোষ মাত্তর চার বাইটের, তাপ্পর লম্বি জুদাই। তোমরা জাতিস্মর হতে চেয়েছিলে, চেয়েছিলে জীবনের পরের জীবনেও আতুমি হয়ে রইতে। অথচ ভুলে গেছ এই জন্মের সম্পর্ক।

সে রাত ছিল দোল। একখানা কাঁসার থালার মাপের অথবা তাঁর ঐ কপাল জোড়া টিপের মতো, হলুদ চাঁদ একা ভেসে যাচ্ছিল। তুমি চিৎ শুয়ে লরির খোলা ডালায়। তোমার মুখের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বেগবতী হাওয়া এবং সমগ্র ধুসর আকাশ। মরমে গেঁথে আছে সে রাত, প্রতিটি অক্ষর; এসেছিল তাঁর বিবাহ প্রস্তাব, তোমার উদ্দেশে...

তোমাদের বিয়ে হলো গোধূলি লগ্নে। আকাশের পরিধানে তখন গাঢ় গেরুয়া; আকাশ সন্ন্যাস আশ্রমে। তোমরা বিয়ে করলে। ছড়ানো ছেটানো কবিতা, গণিত, ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্র ও পদার্থবিদ্যার হাজার খানেক বই, দেওয়ালজোড়া মুর‍্যাল, জানালার পাতাবাহার এবং একচিলতে ব্যালকনিতে ফুটে ওঠা অলৌকিক কনকচাঁপাকে সাক্ষী রেখে তোমাদের আয়োজন-বিহীন, আড়ম্বরহীন, বাবা-মা'র সম্মতি বর্জিত, বন্ধু-বান্ধবদের সহাস্য উপস্থিতি ব্যতিরেক বিবাহ নিষ্পন্ন হলো। লেখার টেবিল থেকে নিঃশব্দে উলু দিয়েছিল নিজস্ব কবিতার খাতা। দেওয়ালে টাঙানো আয়নায় নববধূ দেখলো, তোমার পরিয়ে দেওয়া সিঁদুরে তার অপার্থিব মুখচ্ছবি। উদ্দেশ্য ও চাওয়া-পাওয়ার দাবিদাওয়া ছাড়া, কেবল ভালোবাসা আজও অজর-অক্ষয়, এই বিশ্বাসে আতুমিযাপন শুরু করেছিলে তোমারা দুটিতে। বিবাহ তোমাদের কাছে কোনো প্রথা নয়, কোনো চুক্তিপত্র নয়, কোনো সামাজিক বাধ্যবাধকতা নয়; তোমাদের বিয়ে ছিল এক নতুন-অক্ষরের জন্মক্ষণ। বাবরের প্রার্থনা ও মিনিবুকের দিনটি থেকে তোমরা দুজনে দুজনার হয়ে গিয়েছিলে। সেই নীল কবিতার ডায়রি... মনে পড়ে?


দেড় আঙুলে

তোমার একখানা মুখোশ আছে। বহু ঠেকে ও ঠকে, তুমি শিখছ--- সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট। বাঁচতে হলে ক্যামোফ্লাজ আয়ত্ত করে নিতে হবে। যেমন, অক্টোপাস পারে দুহাজার চারশো তিরানব্বুই রকম রঙ পরিবর্তন করতে। প্রবালে প্রবাল হয়ে, শঙ্খে গাঢ় শঙ্খ হয়ে, বালিতে বালিরঙ হয়ে মিশে যেতে। অবশ্যই আত্মরক্ষা। এবং উদ্বর্তন; বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অন্ততপক্ষে টিকে থাকা।

তবে, তুমি এতটাও দড় হওনি। তুমি কিছুটা মেরা নাম জোকার। হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-ইয়ার্কি-বেদনা নিয়ে হরবখত জাগলিং করছ। এই তোমার মুখোশ। তোমার রঙচঙে নিয়ন মুখ, নাকে লাল টোপলা, ওইসব হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি আর ক্যারিকেচার দিয়ে তুমি মাতিয়ে রেখেছ সার্কাস। পচা টমেটো তোমাকে তাক করে ছুঁড়ে মারলেও, তুমি অবান্তর হেসে উঠছ। তুমি হাসি-ঠাট্টা-মশকরা দিয়ে তৈরি একটা ফানুস। পিন ফুটোলেই ঝরে পড়বে জোকস।

রাত একলা হলে, তাঁবুর শেষ টুনি নিভে গেলে, তুমি 'তুমি' হও। অ্যালকোহলে মুছে নিতে চাও রঙ ও মুখোশ। কোন চোখে জল নামে তোমার? তুমি তো আবার একচোখে হাসতে পারো, অন্য চোখে কাঁদতে! মাঝরাত পেরোলে, তোমার সঙ্গে দেখা হয় নিভৃত তোমার। তখন ভোররাতের তারার মতো নিঃশব্দে ফুটে ওঠে ব্যক্তিগত শোক। চাপা দুঃখ, মাপা কান্না। বাইরের জগতের কাছে যা গোপন, অপ্রকাশিত। আবার সকাল হয়ে এলো। হাসির তলায় কান্নাগুলো চাপা থাকুক আরো একটা দিন। স্টেজে তোমার গালভরা নাম ডাকছে মাইকম্যান। নামকরণের সার্থকতা রক্ষা করতেই হবে তোমাকে সু...

তোমার মধ্যে ওঁত পেতে রয়েছে এক আত্ম-বিধ্বংসী প্রাণী। যে তোমাকে পরীক্ষার আগের রাতে বারবার প্রণোদিত করেছে, 'ওহে পড়ো না এই বাঁধাবুলি, নিউটনের চতুর্থ সূত্র। কি হয় এই তোতাপাখি মুখস্থবিদ্যায় আর দু-পয়সার সাজেস্টিভ অঙ্কের সমাধানে! তারচে, তালাত মেহমুদ শোনো। শোনো মেহেদি হাসান, রঞ্জিস হি সহি। কিছু লেখো। নিজেকে তর্জমা করো। ভাঙতে ভাঙতে এতদকালের তাবৎ, কতটা নামলে খনিতে? কোন স্তর এখন?' ঐ সর্বগ্রাসী পিপাসা তোমাকে দিয়ে পরীক্ষার হলে লিখিয়েছে কবিতা। পকেটে মুড়ে নিয়ে এসেছ পাতা ছিঁড়ে। পরীক্ষার খাতা বাতিল হয়েছিল স্বাভাবিক নিয়মেতেমন কিছু আর লেখা হলো কৈ! বড় অতৃপ্তি। খাণ্ডব দহনের প্রাক্কালে স্বয়ং অগ্নিরও বোধকরি এত ক্ষুধা, সংকট ও অরুচি ছিল না।

কিস্যু হবেনা তোমার। একথা অতীতেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন স্যার। হতেও পারনি কিছু তুমি। এই না হওয়া নিয়ে তোমার আদৌ কোনো অপ্রাপ্তিবোধ আছে? নাকি চাপা অহং? কি মনে হয়? তোমার কেবল একটি শান্ত, নিরুপ্রদব দুপুর ও একফালি হলদে বিকেল ছিল। সেই বিকেলে ছিল তাঁর সঙ্গে অকারণেই রোজ এক নম্বর এয়ারপোর্ট যাওয়া। রাজারহাট ও নতুন-নগরের সারা রাস্তা জুড়ে সারি সারি ঋজু আলোকস্তম্ভ। দূর থেকে মনে হতো ঈশ্বর হাত উপুড় করে আশীর্বাদ করছেন! অবশ্য অনাগত কাল ও দূর হতে কিছু না-কে অনেক কিছু বলে ভ্রম হয়। মরীচিকা। কে ছিলেন তোমার তিনি? আলো? রু? কোথায় হারালে সেই আলোকবর্তিকা? দীপ নিভে গেলে, থাকে সলতে পোড়া ধোঁয়া। নিঃসঙ্গতা।


রাই জাগো রাই জাগো

তোমার বিসমিল্লা ছিলেন তিনি। ছিলেন আদি অক্ষর, প্রণব। তাঁকে দিয়ে শুরু হতো তোমার শুভ বিজয়া, 'ভালোবাসা নিও'যেন কত শত জন্ম জন্ম তোমরা এইভাবে আতুমি হয়ে আছ! তুমি কি কোনো স্বপ্ন দেখছ? ঘুমে আছ? চোখ মিললেই দেখবে, তাঁর অপ্রতিম কোলে তোমার যাচ্ছেতাই রকম ভাবনায় কিলবিলে মাথা; শাপলা ফুলের মতো ফিনফিনে আঙুলে মাথায় বিলি কাটছেন তিনি, মুখের ওপর ঝুঁকে আছে তাঁর প্রতিমাসম মুখ, বড় মায়া। কিছু স্বপ্ন না ভাঙাই বোধহয় ভালো। তাতে যদি চিরঘুমে ঘুমোতে হয়, তাও...

তোমাদের ছিল নিজস্ব ভাষা। এই প্রচলিত বাংলা হরফে অন্য এক জাদুকরী ভাষা। সংকেত লিপি। যে সান্ধ্য ভাষাতে তোমারা নীরবে বলে যেতে অনর্গল কথা। নিছক শরীরী মোহ বা দুদিনের চিত্ত বিকলতা ছিল না তা। এখন যখন কোনো বন্ধনই নেই, কোনো রিঙ-ই বাজে না ফোনে বহু বহু মাস-রাত-দিন; টাচস্ক্রিনে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের অ্যাকুয়াস হিউমার, লোনা জল উবে গেছে উদ্বায়ী কপ্পুরের মতো, তবুও হৃদয়ের অতলে তুমি অনুভব করো, এক অমোঘ প্রশান্তি। পূর্ণতা। তিনি তোমায় ভালবেসেছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য হলেও তা সত্যি।

ছবির মেয়েটিকে তুমি চেনো? হস্টেলের পশ্চিম দিকের তিনতলার ছাদে ছিল এক ভাঙা খাটিয়া। একখানা পা কেবল গোড়ালির কাছে মুচড়ে গেছিল। তা, ইট ঠেকা দিয়ে দিব্যি বসা যেত। তোমাদের বিকেলগুলো ছিল শসা-টমেটো-চানাচুর আর বাদাম ভাজা দিয়ে মাখানো এক ঠোঙা মুচমুচে মুড়ির মতো। তিনি বলতেন বানাম ভাজা’, আবদারে; আহ্লাদে। তিনি কি তোমার খুকী ছিলেন? আর তুমি দাঁড়িওলা কাবুলিওয়ালা! তুমি বড় হাস্যকর রকমের বোকা। ওই ভাঙা খাটিয়ায় বসে তোমাদের কল্পনা ছিল আকাশকুসুম। বন্ধুরা জানতো না, এই একফালি ছাদের ব্যাবিলন। তোমারা জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে যেতে!

নবদিগন্ত থেকে সাঁই সাঁই ছুটে যেত অবিরাম লং ড্রাইভের গাড়ি। তোমাদের ছিল দীর্ঘ দীর্ঘ অবকাশ। ক্লাস কামাই। তোমরা কোয়ান্টাম টানেলিং করে টুক করে ডুব দিতে কড়া ব্যানার্জী স্যারের সাকুরাই-কোয়ান্টাম ক্লাস। সময় থমকে আছে প্রথম দশকের গোড়ায়। তুমি এখন হয়ে পড়েছ জটিল ভগ্নাংশ। লবে আছে সমগ্র আট আট বছর, হর পালটে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তিনি ছবি আঁকছেন ঝুঁকে। কানু বিরহিণী রাই। ‘কত নিদ্রা যাও গো রাধে শ্যাম নাগরের কোলে!’ এই চিত্রকলার নাম মধুবনী। ‘মথুরা নগরপতি কাহে তুম্ গোকুল যাও?’ শুক-সারি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া কচ্চে। তাদের এবার ভিন্ন ভিন্ন দিকে উড়ে যাওয়ার সময় হয়েচে। বুড়ো আঙুল দেখালে ভাব, কড়ে আঙুলে আড়ি। তোমাদের ভাব না আড়ি? নাকি তারও বেশী কিছু অভিমান!

তোমাকে নিয়ে তোমার অহংকার ছিল। অভিমান ছিল। এমন করে কেউ ভালোবাসেনি কাউকে। আতুমি। আমি মুছে গেছে। তুমিত্বের ব্যবধান ঘুচে গেছে। অভেদ ও অভিন্ন দুই প্রাণ, স্পন্দন। কিন্তু হায়! নাভিমূলে তর্জনী স্পর্শ করে কে আর শুধোবে, "প্রসীদ জগজ্জননী"! শুধালেও, সাড়া দিচ্ছে কে? তুমি বুঝে নিয়েছ, 'কাকে বলে নির্বিকার পাখি'...


নীলকমল লালকমল

আজ কত তারিখ? তুমি চাওনি তোমার কবিতা হয়ে উঠুক বিজ্ঞাপন; সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন কিংবা ওয়াশিং পাউডার নিরমা। কবিতা হয়ে উঠবে পড়ন্ত দুপুরের ছাদের বিষণ্ণতা, নেশা নেশা বুঁদ; নখ খোঁটার মতো বাজে স্বভাব, নততলে গড়িয়ে যাওয়া কমলালেবুর মতো কানামাছি খেলা। কলিকাতার পূজোর ভিড় থেকে বহু বহু যোজন দূরে, জয়পুরের বনে কিংবা মানিক্যহারে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে দুই নিরিবিলি চোখ। তুমি তার পর্তুগিজে নাম রেখেছ ইলাবেলা। কষ্টিপাথরে গৌরচন্দ্রের শ্রীপাদপদ্মের ছাপের মতো কিংবদন্তি হয়ে যাবে তোমাদের ভালোবাসা। এই দুরাশায় তুমি একটি একটি করে পল গুনে চলেছ। সময় কি আদৌ গণনীয় রাশি?

কলিকাতার এই কিলবিলে মানুষের স্রোত, শব্দ শব্দ আর শব্দ, নিরন্তর বকবক আর সেলফি-স্পৃহা, তোমার মাথার মধ্যে একটা পাহাড়ের ভার চাপিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে তোমার একান্তই প্রয়োজন রেখা সুবরণ নদীতে অবগাহন এবং নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতা। চুপ থেকে আরো চুপের দিকে যাওয়া। তোমার ভিতরে যে অচেনা, ভিনগ্রহী, অর্বাচীন তুমিটি আছে, তার খবর কী? কথা হয় তার সঙ্গে? বলো, আজ, তার সঙ্গে কথা বলো। বাইরের হাজার বাতি নিবিয়ে, দোর ভিজিয়ে, পা ধুয়ে ভিতরে ঢোকো। তোমার অন্দরমহলে, অন্তরমহলে। সেই ভিতরবাড়িতে আছেন তোমার তিনি, তোমার হারিয়ে ফেলা নদী..

বহুদিন হলো তুমি আর তোমাকে খুঁজে পাও না। তুমি হয়ে গেছ, বেলা বারোটার টবের গাছ। তোমার ছায়া পড়ে না। তোমার মান-অপমান নেই, সুখ-দুঃখ নেই, তুমি কিছুই নও। জড়ও নও, জীব নও। মহাকালের ধুলো মাত্র। এক ফুঁ'য়ে উড়ে গেছ, উড়ে বেড়াচ্ছ অবান্তর। তোমার কোনো উদ্দেশ্য নেই, বিধেয় নেই। তুমি অকর্মক ক্রিয়া। অসমাপিকা। তুমি অব্যয়।

তোমার আত্মা টিমটিম করে জ্বলছেন সাঁঝের কুপি হয়ে কোন চিলেকোঠায়! তুমি সেই নিভু নিভু আলোর পথটুকুও আর খুঁজে পাচ্ছ না। কয়েকটা নুড়ি জমানোর মতো বুক পকেটও, তোমার নেইতুমি নতজানু হয়ে থাকতে চেয়েছিলে। চাওয়াটাই পাপ। তুমি হতে চেয়েছিলে ভালোবাসা নাম্নী মেয়েটির পোষা বিড়াল। বদলে, চাবকে তোমার চামড়া খুলে নেওয়া হয়েছে। তাও তুমি নির্বিকার। ফ্যালফ্যালিয়ে আছ, দন্তরুচিকৌমুদী। তোমার নিজত্ব খোয়া গেছে রেখা সুবরণ নদীর অতলে। গলায় কলসি বেঁধে তুমি ডুব দিয়েছ স্বেচ্ছায়। তুমি একটি আদর্শ 'না হওয়া', কিছু হতে না চাওয়া। তুমি এবার আসতে পারো। ‘everything you touch surely dies...

ঠিক ঠিক জানো না, তবে ইদানীং খানিকটা উপলব্ধি করতে পারছ, তোমার সঙ্গে তোমার মৃত্যুও এক সময়বিন্দুতে জন্মেছিল। তোমার সঙ্গে একইসঙ্গে বাড়ছে তোমার মৃত্যুর বয়স। এখন সে ঊনত্রিশ। তোমারা সমান বয়সী। তোমাকে সে চোখে হারায়। সামান্য পেছন থেকে তোমার খেয়াল রাখে।

কবে কোন রাস্তায় তোমাদের আচমকা মোলাকাত হয়ে যাবে, তা ভেবে ভারি আশ্চর্য হও! যেমন, চলন্ত ট্রেনের দরোজায় দাঁড়ালেই তোমার পা দুটো অবাধ্য হয়ে ওঠে। তারা দরোজা উজিয়ে লাফ দিতে চায়। কতবার যে মুহূর্তের জন্য নিজেকে সামলেছ এই অবাধ্যতার কাছ হতে। অথচ এ কিন্তু আত্মহত্যা প্রবণতা নয়। খুব সুখের দিনে এই উড়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরো বেশি চেপে ধরে।




আতোভা আতোভা আতোভা

আজ শীতকালীন মেঘ করেছে। বাংরিপোসির সেই অনাম্নী আদিবাসী রমণীর খোলা পিঠের মতো আকাশের রঙ এখন! দুই বিনুনি জানু অবধি। তিনি গেছিলেন বাংরিপোসি। তোমার যাওয়া হয়নি। তাঁর হাতে পাঠিয়েছিলে তোমার একজোড়া ঘোলাটে, ডাস্ট অ্যালার্জিক চোখ। তখন বসন্ত, তখন পলাশ।

দুটি লতা শঙ্খ লেগে যেমন জড়িয়ে মড়িয়ে থাকে, দংশন করে উভয় উভয়কে; শীতকালীন বর্ষাপীড়িত দুপুরগুলি তোমাদের তেমনই ছিল। তোমরা এই মর-পৃথিবীর নিয়মের বাইরে। একটি অসমীকরণ। থুত্থুড়ে সন্ন্যাসীর গহ্বরে তিনি রোপণ করেছিলে লতানো পাতাবাহার! তোমরা তো লতার স্বভাবই চেয়েছিলে, আঁকড়ে থাকা, জড়িয়ে থাকা। তোমার জিভে এখনো রয়ে গেছে তাঁর ঠোঁটের নোনতা লহু।

যখন আর কিছু বলার থাকে না, শব্দ ফুরিয়ে যায় মাঝরাস্তায়, আচমকা বৃষ্টি নামে ডিসেম্বরে, তখনই বোধহয় শুরু হয় এই আশ্চর্য কথোপকথন। তুমি ভাবতে থাকো, তিনি এইসময় থাকলে কী বলতেন, জানালার পাশটিতে বসে! তুমি তাঁর ও তোমার হয়ে বলতে থাকো ইকড়িমিকড়ি কথামালা। তুমি ভাবতে থাকো, নির্মাণ করতে থাকো সেইসব মুহূর্ত যা কোনোদিনই আসবে না। অবান্তর সব ঝুটমুট মুহূর্ত তাঁর সনে, যা হওয়ার নয়।

রাণীখেত-কৌশানিতে এমন সরাসরি রোদ ওঠে ফেব্রুয়ারিতে। নৈনিতাল পাহাড়পুঞ্জের নততল বেয়ে ধীরেসুস্থে উঠে আসে সাড়ে পাঁচটার কুসুম রঙা সূর্য। সে আলো গায়ে মেখে ঋজু দাঁড়িয়ে সরলরৈখিক রডোড্রেনডনের ঘন সারি ও তাদের দীর্ঘ দীর্ঘ ক্রিসমাস ট্রি কায়ার ছায়া। সেসময় গুরুজ ফুল ফোটার মরশুম। রুহিণী লাল থোকা থোকা। শিশির স্নাতা পাহাড়ি ঢাল ধরে রডোডেনড্রনের ছায়া বরাবর তোমরা নামতে, গুরুজ ফুল কুড়োতে কুড়োতে। এইভাবেই উদ্দেশহীন হাঁটতে হাঁটতে তোমরা আবিষ্কার করেছিলে সেই পাকদণ্ডী, যা বাঁক নিতে নিতে, ঘুরতে ঘুরতে নেমে গেছে ম্যাঙ্গো-সরোবরে; যার পাড় বরাবর বসে অলৌকিক বাজার, নাক টেপা ফুটফুটে পাহাড়ি কিশোরীদের হাতে বোনা উলের শোয়টার ও মাফলার। এই শীতে প্রিন্সেপ ঘাটের প্যালাডিয়ান পোর্চের আশেপাশে তাঁকে আবিষ্কার করা যেতে পারে, ঐ দুরঙা উলের স্কার্ফ গলায়...

গতকালের থমথমে মুখ ভারের পর, পশলা পশলা কান্নাকাটির পর, তিনি আজ তেরছা হাসি হেসেছেন। তাঁর চোখে আলো। তিনি ইদানীং ঠোঁটের যত্নও নিচ্ছেন! যদিও আজকাল তিনি তোমায় না চেনার জমাটি ভান করেন। কথাটি কন না। তা করুন, তা বেশ। তোমাদের এই নয়মাস ঘেমো গরমের কলকাতার পাকস্থলীতেই লুকিয়ে আছে একফালি ভূ-স্বর্গ! ময়দান থেকে যে পথ ধরে কচ্ছপ গতির ট্রাম রেসকোর্স পেরিয়ে খিদিরপুরে আনাগোনা করে, ম্যাপল ও দেবদারু পাতা-ঝরা ঐ লালচে-নীল-বেগুনি পথে তোমাদের আটখানা বসন্ত অ্যায়সেই গুজর গ্যয়া একপলে! এমন দিনে তোমরা কমলালেবু, ব্যাডমিন্টন ও উত্তুরে হাওয়ার ফুরফুরে, শিরশিরে মন নিয়ে চিড়িয়াখানা বা চড়ুইভাতিতে যেতে ময়দানে। ময়দানের ঘাসের নীচে খোঁজ করলে এখনো পাওয়া যাবে তোমাদের অবান্তর, এমনি-এমনি, শেষ হতে না চাওয়া কথাবার্তা আর কমলালেবুর সিক্ত খোসা, যাতে মোচড় দিলে চোখে লাগতো এক রিনরিনে জ্বালা এবং তাঁর খিলখিলিয়ে হাসি!


নটে গাছটি মুড়োলো

তোমার দিন ছোটো হয়ে আসছে। গত বছর এই সময়ে তুমি নার্সিংহোমে ডেটল-ফিনাইল-ওষুধের গা গুলোনো গন্ধের মধ্যে শুয়েছিলে। তিনি দেখতে এসেছিলেন তোমায় এইরকম এক ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যেয়। চোখের কোলে জল ছিল তাঁর টলোমলো, নার্সদিদি বাইরে যেতেই স্রোত নামলো। কপালে হাত রেখেছিলেন তিনি, বলেছিলেন : 'তোমার অসুখ আমার হোক, তুমি সুস্থ হও।' অসুখ কী? সুখের বিপরীত অথবা অসুস্থতা? সুখ না থাকলেই কি আমরা অসুস্থ হই?

শীতকাল তাহলে এসে পড়লো প্রায়! এবার একটা নেশা ধরলে কেমন হয়? সিগারেট টিগারেট গোছের! ধুস, ওসব উচ্চমাধ্যমিকের বাচ্চারা করে। তুমি বরং ছাদের কিনারে বসা অভ্যেস করো, কার্নিশে হাঁটা। যে হাওয়া উত্তর থেকে বইছে তা কি কেবল দক্ষিণেই যাচ্ছে, নাকি কিছু পূবে-পশ্চিমেও? তোমার ছাদ থেকে তাঁর ছাদের সরলরেখায় দূরত্ব মিনিট কুড়ির হাঁটাপথ। যদি দুম করে রাস্তার মাঝে দেখা হয়ে যায়, কী করবে? হুলুস্থুলু? নির্বাক? স্ট্যাচু? চিনতে না পারার ভান, হেডফোন গুঁজে? নাকি শুধোবে, 'কেমন আছ? চিনতে পারছ?'

সেবছর বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গা পুজোয় তিনি দেবী হয়েছিলেন। মাথার পেছনে অলাতচক্র। ভূত মানে তো অতীত। তোমার কোনো অতীত নেই। পরম্পরা নেই। ইতিহাস নেই। পরিচয় নেই। তুমি সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করছ, বিরজা হোমে আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে আত্মশ্রাদ্ধ করে মস্তক মুণ্ডন করবে। কিন্তু তুমি প্রস্তুত নও। ভোগের তীব্র বাসনা তোমার। তুমি রু নও, তুমি রিপু। তোমার সবকিছু মনে পড়ে। পূর্ব পূর্ব জন্মের কথা। পূর্বাশ্রমের কথা। তুমি কেন ভাব তাঁর কথা? তিনি কি তোমার ইষ্টদেবী? তোমার কুলকুণ্ডলিনী ঘুম ভঞ্জক? তুমি কিস্যু জানো না। অ্যানাস্থেশিয়ার ঘোরে তুমি কেবল তাঁর নাম জপতেই পেরেছ। ঋতুতে ঋতুতে পাতা ঝরে। দেবী চঞ্চলা; আর দেখতে আসেননি। তোমা হতে মতি উবে গেছে তাঁর...

অবশেষে, প্রতিপদের চাঁদ ক্লান্তিতে ডুব দিল। অর্থাৎ, রাত্রিকালীন দিনলিপি ফুরিয়ে এসেছে। দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কুয়াশা নামের এক চন্দ্রাহত তরুণ। শশীকলার আঁধারমানিক পানের ঘোর তার কাটেনি। ক্রমে তার শরীরী উত্তাপ শীতল হয়ে আসছে, এবার বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়বে বারানসীর ঘাটে-আঘাটে। ভোররাতের গঙ্গা তার সদ্যজাত সাত নম্বর সন্তান বিসর্জন দেওয়ায় পর, কতটা অবিচল, তা প্রত্যক্ষ করবেন বলে তিনি বেরিয়েছেন ক্যামেরা কাঁধে; চোখে সানগ্লাস, নোনতা জলে যদি দেওয়া যায় বাঁধ, তুমি ইদানীং তাঁর চোখের বালি। এইসব বিরল ও একান্ত মুহূর্ত তিনি তুলে রেখে দেবেন ডিজিটাল আর্কাইভে। তিনিও তো হয়ে উঠেছেন বিসর্জন-পটু, বিস্মৃতিপ্রবণ; সীমন্তরেখা'পরে স্বেচ্ছায় সিন্দূর মুছে দেওয়া বিরলতমা।

বুকজল পেরিয়ে তুমি নেমে যাচ্ছ গভীরে। পরপর তিন ডুব। শঙ্কর মাছের লেজ দিয়ে তৈয়ারি চাবুক পিঠ কেটে বসে যাচ্ছে, উত্তাপ এতটাই নিম্নগামী, স্নেহ যথা। বিহারী নাপিত পাড়ে বসে আছে। ওর সামনে সক্কলে ঘাড় নত করে। তুমিও করবে তোমার চির উন্নত শির, যা সো-কলড ভালোবাসার পায়ে নুইয়েছিলে, ভুল করেছিলে? এবার তোমার মস্তক মুণ্ডন হবে। পূর্বজন্মের কর্ম ও সম্পর্ক খুরের একটা একটা টানে ঝরে পড়বে। হেমন্তের শেষ থেকেই পাতা ঝরার মরশুম শুরু। তিনি পর্ণমোচী, তুমি ঝরে গেছ তাঁর দেহ থেকে, হিয়া হতে। ‘য়ু হ্যাভ সিন দ্য এন্ড বিফোর ইট বিগান।’ শেষ ও শুরু, শুরু ও শেষ, চক্রবৎ। তুমি এই সংসার-চাকা ভেঙে বেরিয়ে যেতে চাইছ। এখন তুমি পরিধিতে, কিনারে। দ্রুতগামী মেল-ট্রেন থেকে তুমি লাফ দেবে, উড়ে যাবে অন্য ভুবনে। এ পলায়ন নয়, উত্তরণ।

তাঁর ফুলফ্রেম ক্যানন-ক্যামেরা তোমার অবনত, মুণ্ডিত মস্তকে প্রতিফলিত প্রথম সৌরকিরণে কি যে অদ্ভুত এক নিউক্লিয় বলয়, যা চেন রি-অ্যাকশনে যেকোনো পলে ফেটে পড়বে, অবদমিত রিপু-তাড়নায়; সংযম এখনো করতলাগত সাত-অশ্ব হয়ে ওঠেনি, তাই; সেই অপার্থিব সন্ন্যাসের প্রাক-মুহূর্তে তাক করা, নীচু কোণে। তুমি ছবি হয়ে উঠছ তাঁর নিপুণ হাতের প্রফেশনাল ক্লিকে। হয়ে উঠছ শিল্প শোভার সার, তাঁর বাড়ির দেওয়ালে লটকানো প্রণম্য মহারাজ অথবা কাজিরাঙার একশৃঙ্গ গণ্ডার, অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হওয়ার জন্য যাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিঃশব্দে। এদিকে, রাতসারা নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে, সমর্পণের শিখায় দেদীপ্যমান দিয়া...




1 comment:

  1. এক কথায় অসাধারণ লেখা|স্বগতকথন এখানে শিল্প হয়ে উঠেছে|খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে|

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে...

পছন্দের ক্রম