১.
ঘুম থেকে উঠেই এক তীব্র মনখারাপ ঘিরে ধরেছিল আমায়।
এত বড় বাড়ি, টানা বারান্দা, বড় বড় খিলান থেকে চুঁইয়ে পড়া রোদ একদম ভালো লাগে না আমার। আমার পছন্দ একটা ছোট্ট ঘর। এক-টুকরো উঠোন। সেখানে পৃথিবীর সব থেকে ছোট আর নাম-না-জানা ফুল ফুটে থাকবে। তার রঙ হবে
সাদাটে নীল।
বদলে এক
সাদা পোশাক পরা মহিলা এসে দাঁড়াল আমার সামনে। তিনি যে মহিলা সেটা বুঝতেই পারতাম
না, পারলাম তার গলার আওয়াজে। আওয়াজ না বলে স্বর বলাই ভালো। খুব মিহি, নরম ভেলভেটের
মত সে আওয়াজ। মন খারাপের মধ্যে শুয়ে আমি শুনতে পেলাম সে বলছে,
‘যাক, এতক্ষণে ঘুম ভাঙলো তাহলে!’, কথাটা শুনেই আমার মনে
হয়েছিল মহিলার মুখের উপর পড়ে থাকা সাদা পর্দাটা তুলে দিই। কিন্তু চোখ মেলতে গিয়ে
অসম্ভব ব্যথা পেলাম। খুব সাদা আর তীব্র আলোর দিকে চোখ মেলে ধরবার ব্যথা।
‘কেন? আমি তো মাত্র একটা রাত ঘুমিয়ে ছিলাম। কাল দুপুরে আমি
আমার ভাইয়ের সঙ্গে দামোদরের পাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি ... একটা বেজি ধরেছিলাম। সেই বেজি
কাঁধে নিয়ে আমি আর ভাই আমাদের ঘরে ফিরে এসেছিলাম।’
হাসিতে
ফেটে পড়ল মেয়েটি, ‘ভালো বললে। জানতাম এ কথাই বলবে, আমাকে এই
কারণেই বলা হয়েছিল তোমার ঘুম ভাঙার সময়ে মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। না হলে,
তুমি ঘুম থেকে উঠে কিছুই বুঝতে পারবে না। এমনকি তুমি মনখারাপ করে... এক তীব্র
বিষাদে ডুবে ঐ পাহাড়ের উঁচু পাথর থেকে লাফ দিয়ে নীচের নদীতে ঝাঁপও দিতে পার।’
আমি
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দূরে, অনেক দূরে একটা সবুজ পাহাড়। নিশ্চয় ঝরনাও আছে
কোথাও। আমি ঝরনা দেখতে পেলাম না বিছানা থেকে, কিন্তু তার গর্জন শুনতে পেলাম।
সব
তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার। আমার মায়ের মুখ মনে পড়ছিল। বাবার রোদ-পিঠ করে বসার
ভঙ্গি। ফ্ল্যাশব্যাকের মত ভেসে উঠছিল আমার মা-বাবার সেই আর্তনাদ। রাজার সৈ্ন্যরা
এসে তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই রাতে। আমাদের দেশের রাজার একটা চোখ সব সময় কালো
প্যাডে বাঁধা থাকে। রাজাকে প্রায় সারাবছরই যুদ্ধ করতে হয়। তিনি নিজে যুদ্ধ করেন না
যদিও। সৈন্যরাই করে। কিন্তু তদারকি করতে হয় তাকে। আজকাল যুদ্ধে পেল্লায় পেল্লায়
বোম পড়ে না। আলো দিয়ে যুদ্ধই এখন শেষ কথা। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতির মত
এরোপ্লেন উড়ে বেড়ায়। তাদের হাজারো নাম। তার পেটে হাজার কিসিমের ফুটো। সেখান থেকেই
আলো বেরিয়ে আসে। সেই আলোয় নাম লেখা থাকে টার্গেটের। ঠিক সেই টার্গেটের মাথার ওপরেই
গিয়ে পড়ে আলো। নিমেষে মুন্ডু খসে যায়। অনেক সময়ে আলো তাক করে মারা হয় নাভির কাছে। মুন্ডু খসে পড়া মানুষ আমি আর ভাই অনেক দেখেছি। পাশ
দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখেছি, ধস করে রাস্তায় একটা মানুষের মুণ্ডু খসে পড়ল। মাখন খাইনি অনেক দিন। কিন্তু মাখনে ছুরি চালানো কাকে
বলে সেটা জানি। মুণ্ডুগুলো খসে পড়ে ঠিক সে রকম ভাবেই।
কিন্তু নাভির
কাছে তাক করে আলো ছুঁড়লে বিভৎস একটা ব্যাপার হয়। নাভি আর পেট ফুঁড়ে আলো বেরিয়ে
যায়। বেরিয়ে আবার আকাশের দিকেই উঠে যায় বোধহয়। মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকে। আর দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়েই মরে যায়। ঠিক মিনিট-তিনেক পর পদ্মাসনে বসে পড়ে। গাড়ি রেডিই থাকে লাশ
তোলবার জন্য। কারণ আজকাল শুনেছি সারা পৃথিবী জুড়ে বেশ কড়াকড়ি। আলো-যুদ্ধে মানুষ মরে মরুক; কিন্তু
মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে রাখা যাবে না পাঁচ-মিনিটের বেশী।
পৃথিবীতে এখন
দু’জন সম্রাট, রাজা অনেক। রাজারা নিজেদের প্রয়োজন ও
সুবিধা মত সম্রাটদের পক্ষ নেন। রাজাদের নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়িও আছে। সব থেকে বেশী ঝগড়া সাপ নিয়ে। এই ব্যপারটা একটু ভেঙে বলা দরকার।
আগের যুদ্ধে,
বাবার মুখ থেকে শোনা, হেভি মারপিট হয়েছিল। মারপিট মানে ঐ আর কি, আলো ছোঁড়াছুঁড়ি। দেদার আলো ছুঁড়েছিল এ ওর দিকে। সে আলো-যুদ্ধের ঠেলায় সারা পৃথিবীতে এক অদ্ভুত ব্যাপার
ঘটেছিল। প্রায় সবার মাথার ওপর দিয়েই আলোর সরু ছুঁচের মতো রেখা হুসহাস করে উড়ে যেত যখনতখন। কেউ জানতো না কার মাথায় পড়বে। কিন্তু এটা জানতো, দোষ না করলে পড়বে না। আর দোষও কি দু-এক রকম? হাজার কিসিমের দোষ আছে মানুষের। সে সব বললে এক ইতিহাস হয়ে যাবে। তবে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হত গুরুতর দোষেই।
তা সে যাই হোক,
সাপের কথায় আসা যাক। সেই যুদ্ধে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল
সাপেরা। পৃথিবীতে এখন কোন প্রজাতির কত প্রাণী, সব রেকর্ড করা আছে রাজাদের কাছে। শোনা যায়, যুদ্ধের খেয়ালে কারোরই হুঁশ ছিল না। এমন মাত্রায় আলো ব্যবহার করা হয়েছিল যে নাগলোকে হাহাকার উঠেছিল। প্রায় সব সাপই মরে যায়। সারা পৃথিবীতে যুদ্ধের পর সেটাই সব থেকে বড় খবর। এমনিতে আজকাল রাজা-রানির বিয়ে মানুষের
পা-মাড়িয়ে দিয়ে নাকখত দেওয়া ও নতুন আলো-অস্ত্রের আবিষ্কার ছাড়া আর প্রায় কোনও খবরই কেউ পায় না। কিন্তু সাপেদের নিয়ে হেভি ক্যাচাল হয়েছিল। হয়েছিল, কারণ সব রাজাই এর ভুক্তভুগি। রাজারা বৈঠকে বসেছিলেন। আগেকার দিনে, শোনা কথা, রাজাদের অন্দরমহলে সুন্দরী মহিলাদের ভীড় লেগে থাকত। আজকাল রাজারা ওসব মহিলা-টহিলা নিয়ে মাথা ঘামান না। সত্যি কথা বলতে কী, মহিলাদের প্রতি তাদের কোনও টানই নেই। রাজারা নির্বিষ সাপ পোষেন। এক সময়ে রাজারা মরা বাঘের পেটের ওপর পা তুলে ছবি তুলতেন। আগের যুদ্ধ পর্যন্ত রাজারা সাপের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ছবি তুলতেন।
ছবি তুলতেন,
কথাটা একটু ভুল হয়ে গেল। আজকাল আগে ছবি তোলা হয়, তারপর সেটাকে বাস্তবে ট্রান্সফার করা
হয়। ব্যাপারটা বেশ জটিল। আমার মত গণ্ডমূর্খের পক্ষে সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা বেশ
মুশকিল। যদিও আমি আমার দোষের গন্ডমূর্খ নই। দেশের স্বার্থে, বলা ভালো রাজার স্বার্থেই আমি গন্ডমূর্খ। সব রাজারা বসে ঠিক করেছিলেন, দেশের ভালোর জন্যই সব কিছু আনুপাতিক হারে বজায় থাকবে। মানে জ্ঞাণীগুনি-মূর্খ মোটা-রোগা হারামি-ভালো … আরও কত কী।
যাহ, আবার সাপের কথা থেকে হারিয়ে গেলাম। সাপ শেষ হয়ে যাবার পর রাজাদের খাওয়া-ঘুম লাটে উঠল। রাজাদের হজম হয় না, কারণ রাজাদের খাবারটেবিলে
সাপ নেই। খাবার সময় সাপের গা-য়ে হাত বোলাতে বোলাতে
কাঁটাচামচ মুখে না তুললে রাজাদের বেজায় অস্বস্তি হতো। রাত্রে
রাজার সাপের গা’য়ে হাত দিয়ে ঘুমাতেন। কত দিনের অভ্যাস। একদিনে কি আর ছাড়া যায়! তা, এই রকম অনিচ্ছা
নিয়ে খাওয়াদাওয়া ও অনিদ্রার ফলে পৃথিবী জুড়ে সব রাজাদেরই খিদে
মরে যেতে থাকল। রোগা, কঙ্কালসার চেহারা হয়ে গেল তাদের। সেই অল্প সময়ের জন্য মানুষেরা বিপদে পড়েছিল বেশ। চিন্তায় তাদেরও ঘুম ছুটে গিয়েছিল। রাজা ছাড়া তাদের চালিত করবে কে?
যাবতীয় সংকেত,
কোড, পারমুটেশন-কম্বিনেশনের জটিল ইশারা,
সব তো তারাই জানে। পৃথিবী জুড়ে হাহাকার পড়ে গেল। সে যাত্রায় অনেক কষ্টে রাজারা
ক্ষুধামান্দ্য থেকে বেঁচে উঠলেন। নকল সাপ তৈরী করলেন বিজ্ঞানীরা। অবিকল আসল সাপের মত দেখতে। মাঝে একবার বড় বড় কেঁচো দিয়ে চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কেঁচোর একটুও ফনা নেই। ফলে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে
যায়।
আমার মা-বাবাকে রাজার সৈন্য ধরে নিয়ে যায় এই সাপের কারণেই। সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র আমাদের ঘরেই একটা সাপ বেঁচে ছিল।
২.
আমরা ছিলাম বেদে। আমাদের পূর্বপুরুষে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত গ্রামে গ্রামে। যুদ্ধের আগে পর্যন্ত আমরাও সাপ পুষতাম। বিক্রি করতাম আ্মীর-উজিরদের কাছে। বেশ লাভ হত আমাদের ব্যবসায়।
যুদ্ধের সময়ে
সব সাপ মরে যায়। শুধু একটা বেশ নধর সাপ, আমি আর ভাই খুব ভালোবাসতাম সেটাকে, বেঁচে যায়।
সেটিকে আমরা লুকিয়ে
রাখতাম একটা কম্বল চাপা দিয়ে। রাতে আমাদের মাঝখানে সে শুয়ে থাকত। বেচারার সবকটা সঙ্গী মরে যাবার ফলে তারও মন বেজায় খারাপ হয়ে ছিল। পৃথিবীর একমাত্র সাপটি বেঁচে রয়েছে আমাদের ঘরে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিত।
সত্যি কথা বলতে
কী, আমার মা-বাবাকে ধরে নিয়ে চলে যাবার
মধ্যে আমি রাজার কোনও দোষ দেখি না। দোষ আমাদেরই। আমরা সব জেনেশুনেও রাজাকে খবর দিইনি। এমনকি রাজা, সাপের অভাবে দিনের পর দিন না-খেয়েদেয়ে শুকিয়ে আমসি হয়ে উঠছেন জেনেও আমরা বেমালুম চেপে গেছি।
তাছাড়া আমাদের
ব্যবসায় মন্দা নামার কারণে অকালমৃত্যুসুরক্ষাকবচের মেয়াদও ফুরিয়ে গিয়েছিল। ওটা থাকলেও একটা কথা ছিল। আমার এক বন্ধু বিস্তর অঙ্ক কষে দেখিয়েছি সুরক্ষাকবচ কেনা
থাকলে ওরা যে কোনো একজনকে তুলে নিয়ে যেত, হয় বাবা নয় তো মা’কে।
এই সুরক্ষাকবচ
ছাড়া আজকাল এক-পা’ও চলা যায় না। সেই অনেকদিন আগে, যখন দুষ্টু লোকেরা
খেলনা কম্পিউটারে ভাইরাস ছড়িয়ে অকেজো করে দিত সব কিছু, তখন অ্যন্টি-ভাইরাস নামে যে ব্যবস্থা চালু ছিল সেটারই রকমফের অনেকটা এই সুরক্ষাকবচ। তোমার দেশের রাজার কাছে তোমার সুরক্ষকবচ মিলবে না। সেটা অন্যদেশের রাজার জিম্মায়। ঠিক যেমন অন্যদেশের মানুষের কাছে তোমার দেশের রাজা সুরক্ষকবচ বিক্রি করে।
এটাই এখন সারা
পৃথিবী জুড়ে সব থেকে বড় ব্যবসা। বলা ভালো একমাত্র ব্যবসা। সারক্ষণ মানুষকে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে
এই সুরক্ষাকবচ কেনবার জন্য। হাজার রকমের কবচ আছে। খুব ভালো মানের সুরক্ষাকবচের অনেক দাম। সে কবচ, এমনকি আলো-অস্ত্রের বিরুদ্ধেও নাকি প্রতিরোধ দেয়। পৃথিবীতে গুটকয়েক মানুষের জিম্মায় আছে
ওই ধরণের সুরক্ষাকবচ। মাঝারি মানেরগুলো ঐ বছর পাঁচেক টেঁকে। আর আমাদের মত গড়পড়তা মানুষের, যাদের কাঁথাকানিই ভরসা, তাদের জন্য নামকাওয়াস্তে একটা
বর্ম গোছের কিছু। আমার নামেও একটা সুরক্ষাকবচ আছে, এটা ভেবেই আমাদের যত আনন্দ। কাজের সময় শুনেছি সেগুলো সব ফক্কা হয়ে যায়।
৩.
বেশ অনেকক্ষণ
চুপ করে শুয়েই ছিলাম। সেই সাদা পোশাকে ঢাকা মেয়েটি পাশে আছে কি না তা ভুলেই
গেছিলাম। মাথার ভেতর যেন একরাশ কুয়াশা ঢুকে গেছে। একটা বেশ উঁচু পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে
হেমন্তকালে যে রকম কুয়াশা নেমে আসে উপত্যকার দিকে, ঠিক সে রকমভাবে কুয়াশার ভেতর ঢুবে যাচ্ছিলাম
আমি। বুঝতে পারছিলাম, এই জগত আমার পরিচিত
নয়। আবার, অপরিচিতও নয়। মেয়েটি কি আমার মাথার ভেতরটাও দেখতে পাচ্ছে? না হলে সে কেন বলবে,
‘অত চিন্তা করে লাভ নেই খুশিকুমার। উঠে পড়ো এবার বিছানা থেকে… বাইরে গিয়ে একটু ঘোরাফেরা কর। কিন্তু, খবরদার… এই ক্যাসেল থেকে বের হবার চেষ্টা করবে না।’
আমার ভাইয়ের নাম
হাসিকুমার। আমার নাম খুশিকুমার। কিন্তু সে কথা এই মেয়েটা জানলো কি করে? মাথা থেকে কুয়াশা সরে গেল হঠাৎ। আমার এমন হয়। খুব বিপদে পড়লে মাঝে মাঝে মাথা পুরো সাফ হয়ে যায়। বুঝলাম আমি বন্দি হয়ে পড়েছি কারোর আদেশে।
‘উঠে তো পড়বই। কিন্তু আমি কি তোমার নামটা জানতে পারি? আর, এই জায়গাটাই
বা কোথায়? চিনতে তো পারছি না কিছুতেই…।’
‘কেন পারবে না? তুমি তো আমার সেই কবেকার স্বপ্নে
দেখা রাজপুত্র … আমার নাম নাতালিয়া… আর
জায়গাটার নাম শুনে তোমার কাজ নেই। চিনতেও পারবে না… চিনতে যখন পারবেই না তখন সুতাহাটাও যা
সাইবেরিয়াও তা…’
‘আমি অত বড় নামে ডাকতে পারব না তোমায়। শুধু নাতালি বললে রাগ করবে?’
‘একদমই না … স্বচ্ছন্দে বলতেই পার।’
‘কিন্তু আমাকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে কেন? আমার দোষ? আমি তো হাসির সঙ্গে দিব্যি নদীর পাড়ে ঘুরে
বেড়াতাম…’, আমি বিছানা থেকে উঠে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটির মুখের দিকে আমি তাকাতেই পারছি না, এত তীব্র এক সাদা-আলো ছিটকে আসছে তার সর্বাঙ্গ
ঢাকা পোশাকের থেকে।
‘শোনো, ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে ... যদিও আমাদের হাতে মাত্র
একদিনই সময়। তবু কিছুটা ধৈর্য ধরতেই হবে আমাদের। আসলে যে রুটম্যাপ অনুযায়ী আমাদের
চলতে বলা হয়েছে তার বাইরে বেরুলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। পাশের ঘর থেকে ঘুরে এসো
একবার। শুধু মনে রেখ, যা করবে মাথা ঠান্ডা রেখে করবে। আমাদের সবাই এক-সুতোতে
বাঁধা। ঝোঁকের মাথায় কিছু করলে পস্তাবে। যদিও, ওই ঘরে গেলে তোমার এত সব কথা মাথায়
থাকলে হয়...’, মুচকি একটা হাসি হাসল নিশ্চয় মেয়েটি। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম
না। কিন্তু সে মুচকি হাসি যে হেসেছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
বুঝতে পারছিলাম,
পাশের ঘরে একটা বিপদ অপেক্ষা করছে। নাতালিয়ার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সে ইউক্রেনের কোনও কিশোরী। আমি জীবনে ইউক্রেনের কোনও মেয়েকে এক-হাত দূর থেকে দেখিনি। কিন্তু নাতালিয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ন্যাড়া আর রুক্ষ গাছের সার। ঝুরঝুরে বরফ পড়ছে। সন্ধে নামছে দূরে। হাঁটু পর্যন্ত একটা খয়েরি রঙয়ের জুতো, একটা বেশ বড়সড়ো কোট পরে হেঁটে আসছে সে। আমি কি নিজেকে আবিষ্কার করলাম রাস্তার ধারে? নাতালিয়ার সোনালি চুলের ভাঁজে আটকে থাকা বরফের
কুঁচিগুলো কি আমি হাত দিয়ে খুব আলতো করে ঝরিয়ে দিলাম?
পাশের ঘরে ঢুকেই
চটকা ভেঙে গেল। হালকা আলোয় ঘরটা বেশ লাগছে। কিন্তু, ঘরের ঠিক মাঝখানে, সোফায় বসা মানুষটির দিকে আবারও আমি তাকাতে পারলাম না। জীবনে এত কালো পোশাক পরা মানুষ দেখিনি। একবার তাকাতে গেলাম, যেন হাজার হাজার কালো কালো ছুঁচ এসে বিঁধে
গেল চোখে।
‘বোসো। যদি পাশের ঘরের মেয়েটা মাথা না খেয়ে থাকে তো আমার পাশে
এসে এই সোফাতেই বসতে পারো খুশিকুমার’, বুঝলাম আপাদমস্তক কালো পোশাকে নিজেকে ঢেকে রাখা এই মানুষটিও মহিলাই। এর বয়সও খুব বেশী নয়। নাতালিয়ারই সমবয়সী হবে মনে হয়।
‘আমার মাথা খাওয়া সহজ নয়। কিন্তু আমাকে এই অদ্ভুত ভাবে আটকে রাখার
মানে? আর তোমার নামটাও আমি
জানি না কিন্তু…’, আমার রাগত স্বর শুনেও মেয়েটি রাগলো না। বদলে হালকা হাসির সুরেই বলল,
‘কেন খুশিকুমার, ও ঘরের সুন্দরী তোমায় কিছু
বলেনি? না বললে শুনে নাও, আমার নাম স্টিফানি। তোমাকে আটকে রাখার কারণ তো একটা আছেই। কিন্তু মনে রাখবে, হুট করে কিছু করে বসলে কিন্তু তোমারই
ক্ষতি। বলতে পারো আমাদের তিনজনের জীবন-মরণ তোমার হাতেই নির্ভর করছে’, আমি চমকে উঠলাম। আমাকেই কে বাঁচায় তার ঠিক নেই। আমার হাতে না কি আবার অন্য মানুষের জীবন নির্ভর করছে! হাসব, না কাঁদব
ভেবে পাচ্ছিলাম না।
‘মজা পাচ্ছ তো! তা পাও। কিন্তু সেটাও আর ঐ চব্বিশ ঘন্টা। এর মধ্যে কিছু একটা ডিসিশন তোমাকেই তো নিতে হবে…’, মেয়েটির গলায় এমন এক অদ্ভুত বিষন্নতা
ছিল, আমি কেঁপে উঠলাম শুনে।
‘কিন্তু আমি তো জানিই না সমস্যাটা কি? সবই
অদ্ভুত লাগছে আমার। মনে হচ্ছে যেন পাশের টেবিলে বসে রাহু-কেতু-শনি দূর্বোধ্য
ভাষায় কথা বলছে, আর আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না…’, কথাটা শুনে মেয়েটি একটু হালকা হল মনে হয়।
‘বেশ, বলছি। তার আগে একটা উত্তর দিতে হবে। ইয়েস অর নো-এ…রাজি?’, মেয়েটি জিজ্ঞেস করল।
‘আমি রাজি…’। তারপর মেয়েটি ও আমার কথোপকথন ছিল এ রকম,
‘তোমার মা-বাবাকে রাজার লোক ধরে নিয়ে গেছে?’
‘ইয়েস…’
‘তুমি তোমার মা-বাবাকে ফিরে পেতে চাও?
আবার দেখতে চাও তোমার ভাইকে?
‘ইয়েস’
‘পাশের ঘরের ঐ মেয়েটি কি তোমার মাথা খেয়েছে?’
‘নো’
মেয়েটি এবার থামল, ‘বেশ এবার তোমাকে সমস্যাটা বলা দরকার। শোনো, মন দিয়ে। ঐ ঘরে, ঐ যে নাতালিয়া বলে মেয়েটা আছে না... ওদের চোদ্দ-গুষ্টি শয়তানের বংশ। ওর
বাবা একটা রক্তচোষা। মা, বাচ্চাদের খাবারে বিষ মেশায়। আমাদের পাশেই বাড়ি ছিল ওদের।
সব জানি আমরা। তো, একদিন আমার বাবা আনমনে ওর বাবার পা মাড়িয়ে দেয়... সেই নিয়ে কী
সাংঘাতিক হুলুস্থুলু বাঁধিয়ে দিল, চিন্তা করতে পারবে না তুমি। ওর মা এসে আমার
মায়ের বুকে কামড় বসিয়ে দিল। শেষমেষ রাজার লোক এসে, সামাজীক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার
অজুহাতে আমার মা-বাবাকে আর আমাকে ধরে নিয়ে এল। আমাদের সুখের সংসারে আগুন জ্বলে
গেল। যদিও ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, ওর মা-বাবা আর ও’ও রেহাই পায়নি...’
কথাটা শুনে
নাতালিয়ার বাবার ওপর আমার রাগ হচ্ছে বেশ। কিন্তু এক-মুখের ঝাল খেয়ে লাভ নেই।
নাতালিয়ার থেকেও জানা দরকার বিষয়টা। আমি বললাম,
‘বেশ স্টিফানি, তোমার কথা শুনলাম। কিন্তু আমি কী করতে পারি
তোমাদের জন্য সেটাও বল।’
‘তুমিই তো এখন এক্স-ফ্যাক্টর আমাদের কাছে। যদিও তোমার নিজেরও
লাভ আছে। আসলে তোমার এখানে আসার কথা নয়। পারমুটেশন-কম্বিনেশনের
জালে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছ তুমি। কাল রাজার লোক এসেছিল, আমাদের
এখান থেকে মুক্তির একটা ডিজাইন দিয়ে গেল।’
‘কেমন সেটা একটু শুনি?’
‘ব্যাপারটা বেশ জটিল। মন দিয়ে শোনো, রাজার লোক বলেছে আমাদের সামনে তিনটে পথ খোলা। তুমি যদি ঐ শয়তানের মেয়ে নাতালিয়াকে বিয়ে কর, রাতারাতি তোমাদের একটা
সন্তান হবে। সেই সন্তানের মাথা তোমাকে চিবিয়ে খেতে হবে’, কথাটা শুনেই আমার বমি পেতে শুরু করল।
‘যদি না খাই তো কী হবে?’, আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম।
‘তুমি ভিষণ অস্থির, একটু মন দিয়ে শুনলেই সব বুঝতে পারবে।
যদি সেটা না করতে পারো, আলো-অস্ত্রদিয়ে তোমাকে মেরে ফেলবে রাজার লোক। অপরাধ হিসাবে
রেজিস্টার-বুকে লেখা হবে, শয়তানের পেটে সন্তানের জন্ম দেবার অনৈতীক প্রচেষ্টা।
‘আর...’, আমার তর সইছিল না।
‘আর যদি আমাকে বিয়ে কর, রাতারাতি আমাদেরও এক সন্তান
জন্মগ্রহণ করবে। সে কিন্তু আমার পেট থেকে বেরিয়েই তোমার মাথা চিবিয়ে খেতে শুরু
করবে।’
একেই বলে জলে হাঙর আর ডাঙায় চিতা। বেশ বুঝতে পারলাম,
যেদিকেই যাই বিপদ আমারই।
‘আর যদি তোমাদের কাউকেই বিয়ে না করি তো?’, গলা ঘরঘর করে উঠল আমার।
আমি সোফা
থেকে উঠে পড়েছিলাম। স্টিফানি আবার হাসল। এমন একটা সংকটের মুহুর্তেও তার হাসি শুনে
আমি অবাকই হলাম।
‘আরে যাবে যাবে, গিয়ে শুনবে নাতালিয়া আবার কী বিষ ঢালে
কানে। তার আগে আরেকটা কথাও শুনে যাও, এ দুটোর কোনওটাই যদি না কর তো, রাজার আদেশে
আমাদের দু’জনকে মেরে ফেলা হবে। তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, কিন্তু তোমার মা-বাবাকে
চিরদিনের জন্য বন্দি করে রেখে দেওয়া হবে... তার আর ছাড়া পাবে না।’
আমি পাশের ঘরে গেলাম। নাতালিয়ার ভার্সানও প্রায় একই। শুধু সে সব
দোষ স্টিফানির বাবার ওপর চাপিয়ে দিল, যথারীতি।
৪.
সন্ধে নেমেছে
সেই বিরাট ক্যাসেলে। আমি যে সাদা তিলের নাড়ু খেতে খুব ভালোবাসতাম সেটাও খবর রেখেছে
রাজার লোকে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে আজ। আমি একটা নরম তুলতুলে আলোয়ান গায়ে চাপিয়ে
বারান্দায় বসে তিলের নাড়ু খাচ্ছিলাম। মায়ের জন্য বুকটা হাহাকার করে উঠছিল আমার।
কাল ভোরবেলা হয় আমাকে আমারই সন্তানের মাথা চিবিয়ে খেতে হবে; নয়তো আমার সন্তানই
আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।
বহুবার
নাতালিয়া আর স্টিফানিকে এক সঙ্গে বসিয়ে কথা বলতে চেয়েছি। কেউ রাজি হয়নি। মৃত্যুর
প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যে এমন সাপ-বেজি ম্যাটার-অ্যন্টিম্যাটারের মত সম্পর্ক
রাখা যায় আমি সত্যিই ভাবতে পারি না।
রাত্রে ঘুম
আসছিল না কিছুতেই। এক একবার মনে হচ্ছিল, দৌড়ে পালাই এই ক্যাসেল থেকে। পরক্ষনেই সে
চিন্তাকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। পাশাপাশি দু’টি ঘরে বসে আছে দুই রাজকন্যার মত সুন্দরী
নারী। তাদের একজনকে আমায় সম্মতি জানাতেই হবে রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতে। আমার নরম
ফুলের মতো মা আর শালগাছের মত লম্বা বাবাকে রাজার হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতেই
হবে আমায়। তবু প্রাণের মায়া ছাড়তে পারছি না কিছুতেই। ক্যাসেল থেকে ছুটে বেরিয়ে
যাওয়াই যায়। কিন্তু আলো-সুরক্ষাকবচ নেই। হুস করে ঘাড়ের ওপর আলো-অস্ত্র এসে পড়লেই দফারফা। বেঘোরে প্রাণটাই চলে যাবে।
দূর পাহাড়ের
ঝরনার শব্দটাকে রাত্রে গর্জন মনে হয়। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ভাগ্যিস
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! কতদিন পর আমার মায়ের সঙ্গে দেখা হ’ল। মা শুকনো কাঠের মত হয়ে
গেছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা বলল,
‘এত চিন্তা করিস না খুশি... আমি যা বলছি তাই করে দেখ।’
আমি এমনতি বাধ্য ছেলে নই একেবারেই। কিন্তু বিপদে পড়লে মায়ের
কথা শুনি। অনেকটা ভগবানের নাম নেওয়ার মত।
‘তুমি তো জানই মা আমাকে কী কী করতে হবে...’, আমি ঘুমের
মধ্যেই প্রায় কেঁদে ফেললাম।
‘ধুর বোকা ছেলে, তুই এর একটাও করবি না। ওদের বলে দে এই
কথাটা...।’
আমি আঁতকে উঠলাম, ‘কিন্তু না করলে তো ওরা দু’জনেই মরবে।’
মা বোধহয় অনেক দিন পর হাসলো, ‘ওরে পাকা ছেলে আমার, তোর বুঝি
মেয়ে দু’টোকেই খুব পছন্দ?’
‘না না, তা নয়। কিন্তু জলজ্যান্ত দুটো মেয়ে চোখের সামনে মরে
যাবে? তা ছাড়া এটা না করলে তো তোমরাও মুক্তি পাবে না...’
শুনেছি বেদে-বাড়ির মেয়েরা খুব জেদি হয়। মায়ের গলায় সেই সুর
শুনলাম,
‘শুনে রাখ, এসব কিছুই হবে না। কারোর কোনও ক্ষতিই হবে না...
তোকে কানে কানে বলছি খোকা, রাজার দিন শেষ। এই হ’ল বলে। সময় ঘনিয়ে এসেছে তার...’
‘কী ভাবে?’, আমার গলা শুকিয়ে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে উঠল।
‘জানিস খোকা, আমাদের ঘরে যে নির্বিষ সাপটা ছিল, যেটা তুই আর
হাসিকুমার গলায় জড়িয়ে ঘুরতিস ... যেটাকে নিয়ে এত কান্ড-কারখানা... রাজা সেটার
দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিল তোর বাবাকেই। রাজা সেটাকে রাতে নিয়ে ঘুমায়। কিন্তু তোর
বাবা আমাকে সব বলেছে...’
‘কী বলেছে মা?’
‘ঐ নির্বিষ সাপের দাঁতেও না কি বেশ বিষ জমেছে। রাজার খেয়াল
নেই। আজ সে রাজার গলায় কামড় দেবে...’
‘বাবাকে কি ঐ সাপটা বলে গেছে সে কথা?’, আমি জিজ্ঞেস করলাম সরলভাবেই।
মায়ের চোখে
আগুন ছুটছে, ‘বেদের ছেলে হয়ে তোর লজ্জা করে না এ কথা বলতে! তোর বাবা সাপের হাঁচি
চেনে... সাপের সঙ্গে কথা বলে। সে বুঝবে না তো কে বুঝবে শুনি?’
মা
মিলিয়ে গেছে স্বপ্নের মধ্যেই। আমি ভুতুড়ে ক্যাসেলের ভেতর পায়চারি করলাম অনেকক্ষণ।
শেষে মায়ের কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু এই কথাটা তো নাতালিয়া আর স্টিফানিকে জানানো
দরকার। শেষ রাতের চাঁদ ঢলে পড়ছে দিগন্তের দিকে।
নাতালিয়ার
ঘরে ঢুকলাম। নাতালিয়া নেই। অন্ধকার ঘরে লুটিয়ে পড়েছে জ্যোৎস্না।
স্টিফানির
ঘরে ঢুকলাম। স্টিফানি নেই। আধো-অন্ধকার ঘরে জাফরির ছায়া পড়ে।
বুকটা
ছ্যাঁত করে উঠল। তা হলে কি রাজার লোক ধরে নিয়ে গেছে ওদের?
হঠাৎ
দূর্গের গেটের কাছে হাসির কলকলানি শুনতে পেলাম। স্টিফানি আর নাতালিয়া... ঠিক যেন
দু’টো পরী। হেসে কুটোপুটি খেয়ে একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। পৃথিবীর দ্বাদশ
আশ্চর্য দৃশ্য।
দেখলাম
দু’জনেই হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে আর বলছে, ‘বেরিয়ে এসো খুশিকুমার... তোমাকে কিছুই
করতে হবে না... হি হি হি হি... খবর পেয়েছি রাজার গলায় পৃথিবীর শেষ সাপ কামড়
দিয়েছে। রাজা অক্কা.. আমাদের সব্বার মুক্তিইইই...’, ছুটতে ছুটতে হুস করে দূর
পাহাড়ের দিকে মিলিয়ে গেল নাতালিয়া আর স্টিফানি।
আমি
ঊর্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম, কত দিন পর আবার মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে আমার।
আধুনিক রূপকথা। বেশ লাগল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো আপনার
ReplyDelete