বাংলার ‘আধুনিক দিদিমাদের জন্য’ এক স্কুল খোলার প্রস্তাব করেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ,
যে স্কুলের পাঠ্যক্রম হবে শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য তাদের রূপকথার গল্প
বলা শেখানো । দক্ষিণারঞ্জন এর ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ সংকলন তৈরির পেছনে প্রধানতম উৎসাহদাতা
ছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর সেটি প্রকাশের পর সোৎসাহে তার একটি অনবদ্য ভূমিকাও লিখে দেন
সেই তিনিই, ওই লেখাতেই উঠে এসেছিল এই প্রস্তাব। ছোটবেলায় আমরাও ঠাকুমা দিদার কাছে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সেইসব গল্প শুনেছি। আমাদের পরম সৌভাগ্য, আমাদের সেই নাবালক বেলায় আকাশবাণী কলকাতা
প্রতি মঙ্গলবার দুপুরে শিশুদের জন্য রূপকথার গীতিনাট্য শোনাতেন --- বুদ্ধু ভুতুম বা লালকমল নীলকমলের আখ্যান আমরা মুখে শোনার পাশাপাশি কানেও শুনেছি
একসময়। জেনে ফেলেছি সাত ভাই চম্পার করুণ কাহিনি, অরুণ বরুণ কিরণমালা
বা ডালিমকুমারের কথা। ঠিক তখনই মন ভালো-হওয়া বা মন খারাপ-হওয়ার অনুভব তেমন জমাট বাঁধার মতো হয়নি, কিন্তু এইসব
গল্প শুনলে মনের মধ্যে একরকম প্রতিক্রিয়া হত --- এতদূর সময়ের
প্রকোপ ডিঙিয়েও মনে পড়ে এক কল্পরাজ্যের উঁকিঝুঁকি , ঝাপসা কিছু
ভাবনার পরশ। তাছাড়া এইসব গল্পের ভিতর যেসব ভিলেনের
আনাগোনা মা ঠাকুমারা তাদের কাজে লাগাতেন আমাদের ভয় দেখাতে ---- সম্ভবত
‘একানড়ে’ ছিল এমনই এক খলনায়ক যে তালগাছের মাথায়
চড়ে কিম্ভুত ভঙ্গিমায় ছেলেপিলেদের ভয় দেখানোয় সিদ্ধকাম । ওই চরিত্রের ভয়ে কতবার যে চোখ বুজে
ঘুমিয়ে পড়েছি, কতবার অনিচ্ছের খাবার খেয়ে নিতে হয়েছে বিনা প্রতিবাদে পাছে সেই একানড়েবাবু নেমে এসে ঘাড়ে চাপেন। এটা হয়তো রূপকথার এক রকমের আর্ষ প্রয়োগ
হিসেবেও ভাবা যেতে পারে।
যাদের আমরা সরাসরি রূপকথা বলে চিহ্নিত করি, সেগুলি সবই আসলে কাল পরম্পরায় চলে আসা একেক ধরনের লোক কাহিনি সেইভাবে যার কোনও
নির্দিষ্ট লেখক নেই। মুখে মুখে ফেরা এইসব আখ্যান বারবার বদল ঘটেছে প্রজন্মের
ব্যবধানে, লিখিত আখ্যানের বাইরে
তাই তো ছিল তাদের সহজ বিবর্তন। আমাদের মা-মাসিরা যে গল্পগুলি জেনে এসেছেন, হয়তো
আমরা শুনেছি তার থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা । সেদিক দিয়ে ভাবলে রামায়ণ বা মহাভারতের
কাহিনিগুলিও সারা ভারতে একই বিষয়ে ছড়িয়ে থাকা নানা লোকগাথার সমাহার, তাই প্রদেশে প্রদেশে
অঞ্চলে অঞ্চলে তাদের টেক্সটে এত পার্থক্য --- হায়, রাম নিয়ে তেড়েফুঁড়ে ব্যবসা করতে নামা উত্তরভারতীয় ধম্ম-সদাগররা যদি এই গোদা সত্যিটা বুঝতেন ! প্রচলিত লোককথাগুলিকে দুই মলাটে সন্নিবিষ্ট করার যে প্রকল্পে রবীন্দ্রনাথ এতদূর
উত্তেজিত হয়েছিলেন তার একটা সহজবোধ্য কারণ নিশ্চয়ই এই যে এর ফলে মৌখিক চলাচলের বিচ্যুতিগুলো
কিছুটা আটকে দেওয়া সম্ভব, আর, একই সঙ্গে
লিখিত টেক্সটের মধ্যে সাহিত্যের রসকে যেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় মুখের গল্পের শ্রুতি
সাধারণভাবে সেই আস্বাদ দিতে অক্ষম। দক্ষিণারঞ্জন কে তাই বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছিল এই
নানান চেহারার কাহিনিগুলিকে একটা সাধারণসূত্রে বিন্যস্ত করার জন্য, যার জন্য তিনি
কবির সস্নেহ প্রশংসা পেয়েছিলেন।
এর সমান্তরালে আরেকটা কথাও ভেবে
দেখার, বস্তুত তা রবীন্দ্রনাথ
এড়িয়ে যাননি ---- এইসব লোককাহিনির মধ্যবর্তিতায় প্রতিসরিত হয়
বাংলার লোকজীবনের এক পটচিত্র, বাংলাদেশের এক আকরসত্ত্বা---
সামাজিক ইতিহাসের যা এক মুখ্য উপাদান-- কারণ ‘ নিখিল বঙ্গদেশের সেই
চিরপুরাতন স্নেহ হইতে এই রূপকথা উৎসারিত’ । তাই বাঙালির ছেলে যখন রূপকথা শোনে
‘ তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয়, তাহা
নহে ---- সমস্ত বাংলা দেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণ
চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া লয়’। এই নিরীক্ষণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার
মানে হয় না ।
কিন্তু এইসবেরই ভিতর কয়েকটি উৎকীর্ণ
প্রশ্নের সামনে থমকে যেতে হয়। লোককাহিনি হিসেবে প্রচলিত এইসব আখ্যানের সময়কাল ঠিক কত? যদি মৌখিক বাংলা ভাষার
জন্মকাল হিসেব করে দেখি তাহলেও তা দেড়হাজার বছরের বেশি কোনোভাবেই নয়। তার আগের মানুষ ঠিক বঙ্গ নামক কোনও
প্রদেশে বাস করতেন বা বাংলা ভাষায় কথা বলতেন এই তথ্যে ইতিহাসের সমর্থন নেই। কিন্তু যদি এই দেড়হাজার বছরের কথাই
ধরি, এই সময়কালে বাংলাদেশের
বুকের ওপর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার পদসঞ্চার। মূলত কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক সামাজিক
ব্যবস্থা, পেশাভিত্তিক জাতি কাঠামো,
শিক্ষার প্রচলন খুব বড়াই করে বলার মতো নয়, জমি
নির্ভর মানুষের ভরসার জায়গা জমিদারের অনুগ্রহ ---- কিন্তু এই
পুরো চিত্রটার সঠিক দর্পণ কি তুলে ধরে আমাদের প্রচলিত রূপকথা ? সমকালীন যে কোনও আখ্যানে সেই সময়ের প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষ ছবি ফুটে ওঠা খুব
অস্বাভাবিক কিছু নয়, এমনকি তা শিশুশ্রাব্য হলেও যারা সেগুলি নির্মাণ
করেছেন তারা সামাজিক মানুষ, তাদের নানা সঙ্কট থাকবে, না-পাওয়ার বেদনা ও দৈন্য থাকবে এটা প্রায় স্বাভাবিক আর
তাদের রচিত কাহিনিতে তা সচেতনভাবে সরিয়ে রাখা হবে এটা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। কিন্তু আমাদের রূপকথার পাতায় পাতায়
কেবলই রাজা রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের ছড়াছড়ি । তারাই সেখানে নায়ক অথবা প্রতিনায়ক, তাদেরই দুঃখ বা আনন্দের
পশরা সাজানো দেখি পাতায় পাতায় --- রূপকথার সমাজে কোনও সাধারণ
মানুষ নেই ? নেই কোনও কৃষিজীবি মানুষের বারোমাস্যা ? নেই কোনও সামাজিক প্রান্তীয় মানুষের সঙ্কট না-ই হোক অন্তত
কিছু আনন্দের সংবাদ ? যেসব শিশুরা মায়ের বা দিদিমার কোলে শুয়ে
অবাক বিস্ময়ে রূপকথার গল্প শোনে তার মনোভূমিতে শুধু রাজা-রাজড়ার
চাষবাস , কেবল তাদেরই নিয়ে সমাজের পথচলা --- এই বার্তা নিয়েই বুঝি তারা ঘুমোতে যায় ?
দক্ষিণারঞ্জনের ওই সঙ্কলনের ভূমিকা
লিখবার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন অন্য আরো একটা কথা, তা হল, বাংলার এই গান, গল্প, কথকতা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে এবং তার ওপর এসে পড়ছে ইউরোপীয়
শিক্ষার প্রভাব। যার ফলশ্রুতিতে হয়তো বা তার প্রাণরসের বেগ ও আবেগ অনেকটা স্তিমিত
হয়ে যাওয়ার শঙ্কা । ১৯০৭ সালের আশেপাশে যখন ওইসব রচনাগুলি
জড়ো করার কাজ করছিলেন দক্ষিণারঞ্জন তখন বাংলাদেশে অন্তত ইউরোপীয় শিক্ষার ভিত্তি খুব
দৃঢ় কাজেই রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল, সঠিক ভাষার মধ্যবর্তিতায় সেইসব কাহিনি নতুন
করে লিখে ফেলার কাজটা করে ওঠা যাবে কি না । আমরা জানি, এই কাজে সাফল্যের জন্য
তিনি দুহাত তুলে সমর্থন করে দক্ষিণারঞ্জন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ তিনি ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন, তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ’ । কিন্তু ঘটনা হল, কালে কালে এই রূপকথার
যে রূপান্তর সেখানে এই ছাপ এড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। তারপর বাংলাদেশের নদীনালা দিয়ে অনেক
জল গড়িয়েছে , রূপকথার রূপান্তর ঘটেছে আধুনিক সায়েন্স ফিকশনে বা হরর মুভিতে ---- শিয়ালপণ্ডিত
থেকে স্পাইডারম্যানে কিংবা হেঁড়ে গলার হিড়িম্বা থেকে হ্যারি পটারে । সেইসব দেখেশুনে আমাদের মন খারাপ হয়, ভাবতে থাকি এর থেকে
তো ঢের ভালো ছিল রাক্ষস খোক্কোস বা পাতাল কন্যা মণিমালার গল্প ! ঠিক । কিন্তু তারও আগে থাকে একটা প্রশ্ন । আজকের বদলে যাওয়া রূপকথায়, যেখানে কথা ও কাহিনি
যত প্রত্যক্ষ, রূপের প্রকাশ তত জরুরি আর নয় এবং তাতে শিশুমনে
হিংসার বীজ রোপণ বা অন্যান্য বদরোগের ভাইরাসের ছেয়ে থাকা নিয়ে আমরা কেবলই বিমর্ষ
--- কিন্তু সাবেকি রূপকথাও কি এর বাইরে ?
কেন বলছি কথাটা, ঠাকুরমার ঝুলির অন্তত
বেশির ভাগ গল্পেই দেখি এক চোরা হিংসার ছবি। একজন রাণীর কেবলই সন্তান হচ্ছে আর বড়
রাণী সেগুলিকে আঁতুড়ঘরেই মেরে ফেলছেন, একজন রাজা তার পছন্দমতো কাজ না হলেই শাস্তি
দিচ্ছেন প্রজাদের এবং কোথাও কোথাও রাণিকে বা রাণীদেরও । টুনটুনিকে ঊচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে রাজার
যখন নাক কাটা যায় তখন লোভী রাজার জন্য আমাদের কোনও সহানুভূতি জাগে না, যা অনুভব করি তা মজা। কিন্তু সতীনের ছেলের রক্ত দিয়ে যখন
রাণি স্নান করতে চান এবং রাজা সেই আদেশ দিয়ে জল্লাদকে পাঠান, এর মধ্যে কি শুধু আমোদ
বলে আমরা এর বিপজ্জনক দিকটা উপেক্ষা করতে পারি ? রূপকথার নানা
কাহিনিতে এমন সব হিংসা, স্বার্থপরতা, ষড়যন্ত্র
– শিশুমন কি এগুলো শুনে শুনে বড় হলে তা খুব স্বাস্থ্যকর বলে আমরা মেনে
নিতে রাজি ? আবার সেই প্রশ্নটাও ফিরে আসে, এই ক্রূরতা আর হিংসাই কি বাংলাদেশের একমাত্র সমাজচিত্র ? সেই সমাজে কোনও ভাল মানুষ নেই , নেই কোনও অন্য মানবিক
গুণের পরশ ? এই প্রশ্নগুলো এখনও তেমনভাবে করা হয়নি আমাদের ।
পরের প্রসঙ্গটাও বেশ আপত্তির, তবে অস্বীকার করার মতো নয় । কারণ, কল্পনা ও স্বপ্নের উড়াল রূপকথার প্রাণসত্তা হলেও
কোথাও তার একটা যৌক্তিক ভিত্তিও থাকা দরকার। আকাশের চাঁদকে শিশুর কপালের টিপ হিসেবে
কল্পনা বা সূর্যের উদয়ের সঙ্গে সাত ঘোড়ায় টানা রথের চলন ভেবে নেওয়ায় সেই কল্পনার পাখা
মেলার অবকাশ আছে। কিন্তু রূপকথার কাহিনির একেবারে গোড়ায় যখন পড়ি, রানির সন্তান হচ্ছে
না বলে সাধুবাবা এসে একটা শিকড় দিলেন যা বেটে খাওয়ালেই নাকি কোল আলো করে শিশুপুত্র
আসবে ---- এর মধ্যে একটা অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক চেতনার ফসল আছে যা আজকের শিশুকে গিলিয়ে
দেওয়া নৈতিকভাবে বেঠিক। একইভাবে ভুল, সেই শিকড়বাটা জল খেয়ে কারোর মানব সন্তান প্রসব
ও কারোর বানর সন্তান প্রসবের গল্পটা। মানবজন্মের গূঢ় রহস্য আমরা শিশুদের থেকে আড়াল
করার চেষ্টা করি ঠিকই কিন্তু সেই চেষ্টার মধ্যে এমন বিজ্ঞানবিরোধী মানসিকতার কুয়াশা
তৈরি কতদূর সমর্থন করা যায় সেটা বিস্তারিত বিতর্কের প্রেক্ষিত দাবি করে। একইসঙ্গে প্রায়
প্রতিটি আখ্যানে একজন রাজার একাধিক রাণী থাকার যে খবর শিশুমন জেনে নেয় এর মধ্যে কোথাও
আছে একটা নারীচেতনা বিরোধী অবস্থান --- সত্যি সত্যি আজকের শিশু তার নিউক্লিয়ার পরিবারে
কি এই অবস্থার প্রতিফলন দেখতে পায় ? তাহলে একজন রাজার একাধিক নারী সহচরী থাকার বাস্তবতা
তাকে কি কোনো বাড়তি কল্পনার ডানা দেয় নাকি এক বিপরীত বাস্তবের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে
? বরং এখানেও একটা প্রশ্ন একই সঙ্গে দানা বেঁধে ওঠে, বাংলার সামাজিক জীবনের সর্বত্রই
কি এই বহুগামিতার প্রকোপ ছিল যা নাকি ধরা পড়েছে এইসব আখ্যানে ? বাংলার প্রান্তীয় মানুষের
স্বর যদি তাদের মতো করে কোথাও নথিভুক্ত হত এই আবহমান লোককাহিনিগুলির পাতায় পাতায় তাহলে
ঠিক কেমন দাঁড়াত এর আদল তা এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। আর সামাজিক বাস্তবতায় কোনও সন্তানহীনা
নারীকে ‘আঁটকুড়ো’ নামে চিহ্নিত করা আজ আর কোনও শীলিত সমাজের অভিজ্ঞান নয় কিন্তু ঠাকুরমার
গল্পের ভিতর এইসব চিহ্নিতকরণের সঙ্কেত আমাদের বেশ একটু সমস্যায় ফেলে বইকি!
রূপকথা নিশ্চয়ই আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের খাঁটি স্বদেশী জিনিস। কিন্তু সমস্ত উত্তরাধিকারের
সবটাই বিনা শর্তে গ্রহণ করা খুব আধুনিক মনের পরিচয় নয়। বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলিও আমাদের
সংস্কৃতির সম্পদ কিন্তু তুলনায় সেখানে আধুনিক মননের প্রকাশ ঘটেছে স্পষ্টতায়, সেই একই
ধারা পাওয়া যাবে বাংলার লোকগানে । কিন্তু আমাদের
রূপকথার ভিতর যে এইসব বিভ্রান্তির অবকাশ থেকেই গেল তাই বা আমাদের চর্চার বাইরে থাকবে
কেন ?
No comments:
Post a Comment