এক
'ছোট্ট গোল রুটি/ চলছি গুটিগুটি / গমের ধামা চেঁছে/ ময়দার টিন মুছে/ ময়ান দিয়ে ঠেসে / ঘি দিয়ে ভেজে/ জুড়োতে দিল যেই / পালিয়ে গেলাম সেই / বুড়ো পেল না / বুড়ি পেল না / খরগোশ পেল না / নেকড়ে পেল না / ভালুক পেল না / সেয়ানা শেয়াল, তুইও পাবি না।'
একটা গোল রুটি। রুটিটা গড়গড়িয়ে চলেছে গল্পের বরফঢাকা উপত্যকা বেয়ে। বুড়ো, বুড়ি, ভালুক, খরগোস, শেয়াল সকলেই খেতে চাইছে তাকে। কেউ পারছে না। আমরা যারা আশির দশকে কিশোর কিশোরী ছিলাম... যাদের একটু আধটু গল্পের বই পড়ার অভ্যেস ছিল, তারা হয়তো সকলেই এই গল্পটা চিনি। 'রুশদেশের উপকথা'-র প্রথম গল্প। ননী ভৌমিক সোভিয়েতে গিয়ে, থেকে, সে দেশের লোককথা সংগ্রহ করে, পড়ে, অনুবাদ করে, লিখে ফেলেছিলেন এই অসামান্য বই। ঠাকুরমার ঝুলি, বুড়ো আংলা, পদিপিসির বর্মী বাক্স-এর মতো এই বইও বাংলা সাহিত্যের এক সেরা সম্পদ।
১৯৫৭ সালে প্রগতি প্রকাশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অনুবাদকের কাজ নিয়ে মস্কো চলে যাচ্ছেন ননী ভৌমিক। আর তার বছর পনেরো বাদে, হুগলি শিল্পাঞ্চলে, একটি ছিন্নমূল পরিবারের অযত্নলালিত পঞ্চম সন্তান, যিনি ঘটনাচক্রে আমার পিতৃদেব, তাঁর একদা ব্রিটিশ কোম্পানিটা মালিকানা হস্তান্তরজনিত কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ আমার বাবা-মা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, সদ্য, আর তার কিছুদিনের মধ্যেই বাবার চাকরি নেই। কিন্তু রুটির গড়ানো তো বন্ধ হলে চলবে না। মা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সামান্য মাইনেয় শিক্ষকতা করছেন, পাশাপাশি নিজের পিতৃহীন ছোট ছোট ভাইবোনের পড়াশুনোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। অন্যদিকে ছোট-বড় নানা কাজ খুঁজে খুঁজে করে চলেছেন বাবা। একমাত্র আর্থিক কারণে বিলম্বিত হয়ে চলেছে তাঁদের একমাত্র সন্তানের জন্ম। বেশিদিন অপেক্ষা না করে বড় রাস্তার পাশে একখণ্ড জমিতে সেকেন্ডহ্যান্ড লেদ মেশিন কিনে ব্যাবসা শুরু করে দিলেন বাবা। পুঁজি বলতে অতি সামান্য সঞ্চয় ও বছর দশেকের অভিজ্ঞতা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল সেবছর। বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সেবারই রাজ্যে প্রথমবার ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট। একটি শিশুরও জন্ম হল।
কয়েক বছর পর সেই ছোটখাটো কারখানায় আরও ছোট আমি সবে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছি। বাবা আস্তে আস্তে আরও কয়েকটা মেশিন কিনে ফেলেছেন, বলাই বাহুল্য, সবক'টি সেকেন্ডহ্যাণ্ড। সেইসব মেশিনের ঘর্ঘর ধ্বনি ও মধ্যবর্তী নীরবতার মধ্যে কাটছে আমার স্কুলছুটির দুপুরগুলো। অ্যাসবেস্টসের নীচে জমে ওঠা উষ্ণ হাওয়ায় মবিল গ্রিস আর লোহার গুঁড়ো মিলেমিশে কেমন যেন অন্যরকম একটা গন্ধ। ক্লাসে বীজগণিতের অংক শিখতে তখনও ঢের দেরি, কিন্তু ততদিনে আমি জেনে গেছি মিলিং মেশিন কী কাজ করে, গ্রাইন্ডিং বা ওয়েল্ডিং কেন করতে হয়। একটি ধাতুখণ্ড কীভাবে এক যন্ত্র থেকে আরেক যন্ত্রে রূপ বদলাতে থাকে আর ধাতুপোড়া গরম বাবড়ির টুকরো এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে তাই দেখে যেতাম।
এমনই এক নির্জন কর্মব্যস্ত দুপুরে কারখানায় বাবার টেবিলে প্রথমবার এসে পড়ল একখানি বুকপোস্ট। প্যাকেট খুলে পাওয়া গেল একটি ম্যাগাজিন। না, 'আনন্দমেলা'-র মতো আকারে ছোট নয়, ঢাউস, আদ্যন্ত চকচকে মসৃণ কাগজে ছাপা, রঙিন ছবিতে ভরা এক পত্রিকা৷ অনুবাদ করা নানা লেখা, অচেনা দেশের না-চেনা শহরের ছবি, জীবনযাত্রা, মানুষের হাসিমুখ, লাল লাল ফুলোফুলো গালের বাচ্চাদের ছবি। তারপর থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাবার তেলকালিমাখা টেবিলে ছপাত করে এসে পড়ত এই বুকপোস্ট। অপেক্ষায় থাকতাম। বুক পোস্টের কাগজ ছিঁড়ে মলাটে নাক ঠেকিয়ে গন্ধ নেওয়া ছিল আমার প্রথম কাজ৷ দ্রুত ছবিগুলো দেখে নিয়ে পত্রিকার শেষে চলে যেতাম। সেখানে তখন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ছোট ছোট লোককথা, ইয়াগা আর যাদুকরী ভাসিলিসার কাহিনী, ইভান নামের তেজী ছেলেটার দুরন্তপনার গল্প। আর হাতে আঁকা দারুণ দারুণ সব ছবি। তখন খেয়াল করিনি, অনেক পরে জেনেছি, এই লেখাগুলোর অনেকগুলোই বেরিয়েছিল অরুণ সোম, রেখা চট্টোপাধ্যায়, এবং অবশ্যই ননী ভৌমিকের কলম থেকে। রাশিয়ান মেয়ে শ্বেতলানাকে বিয়ে করেন তখন মস্কোতেই পাকাপাকি সংসার পেতেছেন ননী। পাশাপাশি, রুশ থেকে বাংলায় লিখে চলেছেন অনর্গল। তাঁর লেখায়, ছবিতে-গল্পে আমার কিশোর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারের এক অজানা ও সর্বার্থে রূপকথার দেশ।
দুই
আমাদের ছোটবেলার মফস্বলী সকালটা ভারি মনোরম ছিল। প্রতিদিন ঠিক সকাল ছ'টায় অদূরে চটকল থেকে ভেসে আসা লম্বা ভোঁ শুনে ঘুম ভাঙত৷ হুগলি নদীর তীরে ছোট-মাঝারি-বড় নানা শিল্প দিয়ে ঘেরা আমাদের শান্ত সবুজ মফস্বল। এমনই কোনও এক কারখানার রাতের দারোয়ান রামশরণ গোয়ালা রোজ সকালে নিজের হাতে দোয়ানো গরুর দুধ দিতে আসতেন আমাদের বাড়ি। ভোরবেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসার খানিক পরে রিনিদিদিদের বাড়ি থেকে ভেসে আসত গলা সাধার আওয়াজ। শুধু রিনিদিদি নয়, তখন বাড়ির মেয়েদের সকাল-সন্ধে হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজে বসার নিয়ম ছিল। লাল ফিতে দিয়ে দু’টো বিনুনি বেঁধে গান গাইতে বসেছে রিনিদিদি, ওদের বাড়ি গেলে দেখতে পেতাম। প্রথমে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তারপর কোনওদিন নজরুল, কখনও দ্বিজেন্দ্রলাল। কোনও কোনওদিন সকালে বাবার সঙ্গে বাজারে গেলে দেখতাম প্রায় গোটা রাস্তা জুড়ে যেন সাইকেলের মিছিল, ক্রিং ক্রিং কোরাস। হাতলে কাপড়ের ব্যাগ, তাতে টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে আশেপাশের কলকারখানাগুলিতে সকাল আটটার শিফটে যোগ দিতে যাচ্ছে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কর্মীদল। আবার তাঁদেরই আয়ের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে আছে অনেক ছোটবড় দোকানদার, সেলুন থেকে চা-ওলা। বস্তুত, আশির দশকে আমাদের মফস্বলের অর্থনীতির একটা বড় অংশ এইসব কলকারখানাগুলির স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
প্রতিবেশী যতীনকাকা জনস্টন পাম্পের ফিটার ছিলেন। পরে শুনেছি, উনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজ পড়তে আসতেন। বাবার সঙ্গে বসে চা খেতেন। নেড়েচেড়ে দেখতেন ডাঁই করে রাখা পুরোনো 'সোভিয়েত দেশ'। আমাকে ওখানকার বড় বড় কারখানার ছবি দেখিয়ে বলতেন, জানিস, ওই দেশে সবাই সাধ্যমত কাজ করে। সবার কাছে কাজ আছে, কাজের পর মানুষ নির্ভাবনায় আনন্দে মাতে। ও দেশে বেকার নেই, সবার জন্য খাবার আছে, থাকার ঘর আছে। চুরিচামারি নেই, অসুখবিসুখ ছাড়া কারও কোনও দুঃখকষ্ট নেই। দরকারের বেশিরভাগ জিনিস সরকার থেকে দেওয়া হয়, বাজার থেকে কিনতে হয় না। যতীনকাকা যা বলে যেতেন, আমি বুঝতাম না অনেকটাই, তবু শুনতাম, শুনতে ভালো লাগত। যতীনকাকা বলতেন, একদিন সারা পৃথিবীটা এইরকম হয়ে যাবে, কোনও শোষণ থাকবে না, দেখিস! দেখতাম, কথাগুলো বলার সময় চকচক করে উঠছে ওঁর চোখ।
এহেন শিল্পাঞ্চল-নির্ভর আমাদের মফস্বলে একটা বড় উৎসব ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। আমাদের বাড়িতে অর্থাৎ বাবার কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজো হত। বিশ্বকর্মায় স্কুল ছুটি থাকলেও একমাত্র আমি ছাড়া আর কোনও বন্ধুর বাড়িতেই এই পুজো হত না, এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল আমার। আগেরদিন স্কুল থেকে ফিরে মা আর কারখানার কাকুদের সাথে বাজারে যেতাম। বাবা যে এইসব প্রস্তুতির কাজে সবসময় থাকতে পারতেন, তা নয়। সেপ্টেম্বর মাসটা জুড়ে পেমেন্ট আদায়ের জন্য বাবাকে ছোটাছুটি করতে হত। বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক আগের দিন বাবা সমস্ত কর্মচারীদের পুজোর বোনাস দেওয়ার চেষ্টা করতেন। পুজো শেষে দুপুরে সকলের জন্য গরম গরম মাংস ভাত। তখন মাংস মানে শুধুই খাসি। মনে আছে, সেই সময় কোনও এক বছর বাবার সঙ্গে কেরুলিয়া বাজারে মাংস কিনতে গিয়ে খাসির মাংসের দর দেখেছিলাম, এক কিলোর দাম চৌত্রিশ টাকা।
সন্ধে নামলে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া যেত। মফস্বলের আনাচেকানাচে, বি টি রোডের দু'ধার দিয়ে সারবাঁধা অজস্র ছোটবড় কারখানা। অন্যদিন পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হত, এত উঁচু উঁচু পাঁচিলের ওধারে আছেটা কী! বছরের এই একটিমাত্র দিনে কারখানাগুলোর গেট সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হত। কারখানাগুলোর আভিজাত্য অনুযায়ী একেকটা পুজোর একেকরকম ঠাঁটবাট। কোনও কারখানার ঠিক মাঝখানে কেয়ারি করা ফুলের বাগান, তাতে লাল নীল আলোর নৃত্যরতা ঝরনা। জনস্টন পাম্পে গেলেই যতীনকাকু আমাদের ধরে বসিয়ে পেট পুরে মিষ্টি খাইয়ে দিতেন। সারা কারখানা ঘুরিয়ে দেখাতেন। ভিতরে ঢুকে দেখতাম বড় বড় নাম-না-জানা মেশিন, আকাশছোঁয়া ক্রেইন, তীব্র ওয়াটের আলো। 'সোভিয়েত দেশ'-এ দেখা বিশাল বিশাল কলকারখানার ছবিগুলোর সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম৷ আমাদের চোখের সামনে বিভিন্ন আকারের দৈতাকৃতি ইস্পাতের স্তুপ মাইল জুড়ে নিঃশব্দে শুয়ে থাকত।
বাড়ি ফিরে দেখতাম বাবার কয়েকজন বন্ধু এসেছেন, যমুনা আংকল, আনসারিকাকু। প্রতি বছরই আসেন৷ বন্ধুদের নিয়ে বাবা বসেছেন চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটায়। মা ওখানে যেতে বারণ করতেন। বলতেন- 'ওখানে বড়রা আছে, তোমার যেতে হবে না। এখানে বোস।' তাও লুকিয়ে চলে যেতাম। চিলেকোঠার ঘরের ভেজানো দরজাটা খুব সন্তর্পণে আলতো ফাঁক করলেই ভক করে বেরিয়ে আসত ঝাঁঝালো গন্ধ। এর মধ্যে একটা গন্ধ আমি চিনি। ক্যাপস্টান। বাবা খান। ঠিক একই সময় কারখানাতেও বড় লেদটার পেছনে জটলা, অজিতকাকুদের হাতে চা খাওয়ার স্টিলের গ্লাস। পোড়া বাবড়ির বদলে বাতাসে আমোদের গন্ধ।
পরে, স্কুলজীবনের শেষের দিকে সবে বুর্জোয়া প্রলেতারিয়েত এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হচ্ছি। একজন বাঙালির ছেলের ওই শব্দগুলি না শুনে উপায় নেই। ভোটের আগে মাইকে পার্টির লাগাতার প্রচার হত। খবরের কাগজ, এদিক ওদিক থেকে টুকটাক লেখা পড়ে, ব্যাপারগুলো মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম। তার মানে সোজা হিসেবে, বাজাজ আংকেল, আমার বাবা এরা সবাই পুঁজিপতি ছিলেন, আর কারখানার কাকুরা শ্রমিক অর্থাৎ সর্বহারা। বলা আছে, পুঁজিপতিরা তো শ্রমিকদের শোষণ করে নিজেদের মুনাফা বাড়ায়। তার মানে কি বাবাও কাকুদের শোষণ করত? মাইনে কম দিত? একদিন স্কুলের বসে সময়মতো উঠতে না পারলে, তপনকাকুকে সাইকেলে করে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বলত বাবা। মা ভালো কিছু রাঁধলে কারখানার কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিত দিদার বাড়ি। এগুলোও কি শোষণ ছিল? পাশাপাশি, এমন দিনও গেছে বাবা পেমেন্ট না পেলে কারখানায় মাইনে দেওয়ার জন্য মা’র বেতনে হাত পড়েছে। আমাদের কারখানা একবার বন্ধ হয়ে গেছিল। শুনেছিলাম তপনকাকু কাজে কী একটা বড় ভুল করায় বাবা মাথা গরম করে একটা বাজে খিস্তি দিয়েছিল। সেদিন থেকে সবাই মিলে কাজে আসা বন্ধ করে দেয়। স্ট্রাইক। শব্দটা জানতাম। বাবাকে আমার সামনে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। তার মানে কি বাবা আড়ালে খিস্তি দেয়? সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, বাবাকে কোনওদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। আজ এতদিন পরে বৃদ্ধ, অবসৃত বাবাকে ক্ষতি সামলাতে না পেরে বন্ধ করে দেওয়া কারখানাটার কথা মনে করানোরও কোনও মানে নেই। সেবার সাতদিন বন্ধ থাকার পরে কারখানাটা আবার খুলেছিল, কিন্তু সম্ভবত সেদিনের ঘটনায় আমার রূপকথাময় শৈশব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে যায়।
তিন
১৯৯১ সালে, ক্রিসমাসের পরদিন, সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। সোভিয়েত মানে শুধুই রুশদেশ ছিল না, আমরা খেয়াল করিনি, এর সঙ্গে মিশে ছিল ইউক্রেন, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ইত্যাদি আরও চোদ্দটি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব। প্রত্যেকে মাথা তোলে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করত বিশ্বজোড়া যেসব অগুনতি মানুষ, তাঁদের পাঁজরে ভাঙচুরের শব্দ ওঠে৷ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! নাকি এমনই হওয়ার ছিল? যতীনকাকা? শুধু কি বাইরের চাপ, নাকি ভিতরেই গাঢ় হয়ে ঘনিয়ে এসেছিল সংকট, যা দূর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত বোঝা যায়নি। সোভিয়েত দেশ-এর সেইসব উজ্জ্বল পৃষ্ঠা, হাসিভরা লাল লাল গালের ছেলেমেয়েদের মুখ, অত আনন্দ আর খুশি সেগুলো তার মানে সত্যি সত্যিই অতটা সুন্দর ছিল না, ভাঁওতা আর অবদমন মেশানো ছিল তার সাথে? কিন্তু ওই যে স্বপ্নটা, সারা পৃথিবী একদিন এইরকম সুন্দর হবে, থাকা-খাওয়ার কষ্ট থাকবে না কোনও, সবার জন্য কাজ থাকবে, কাজের পরে গান থাকবে, সাহিত্য থাকবে, ঐ স্বপ্নটাও কি স্রেফ আরেকটা রূপকথা-ই ছিল তার মানে?
আর যিনি বাঙালি ছেলেমেয়ের জন্য রূপকথার গল্প লিখতেন মস্কোয় বসে, তাঁরই বা কী হল? তথ্য জানাচ্ছে, একানব্বইয়ের পরেও আরও পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন ননী ভৌমিক। তখন তিনি এক স্বপ্নহীন কর্মহীন বৃদ্ধ, একইসঙ্গে অর্থকষ্টে জীর্ণ ও পুত্রশোকে কাতর। আর স্বপ্ন না দেখলে কি আদৌ বেঁচে থাকা যায়! ১৯৯৬ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মস্কো শহরেই এক পথদুর্ঘটনায় মারা যান ননী ভৌমিক। প্রতিবিপ্লব-উত্তর দেশে রূপকথা লেখার মানুষের প্রয়োজনই বা কী?
প্রতিবিপ্লব শুরু হয়েছিল গঙ্গার পারেও। যতীনকাকার কারখানা তখন প্রায় বছর দুয়েক বন্ধ। শুধু তাঁরই নয়, হুগলির দু'পারে একের পর এক কারখানায় তালা ঝুলে যাচ্ছিল। কারণ অনেক, প্রতিটি ভারী শিল্প একদিন না একদিন যেসব কারণে শুকিয়ে যায়... প্রযুক্তির পুরোনো হয়ে যাওয়া ও তাও তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা, নতুন বিনিয়োগের অভাব, প্রতিযোগিতার বাজারে একসময়ের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ও কর্মসংস্কৃতি-বিচ্ছিন্ন ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন ইত্যাদি। আশির দশকের শেষ আর নব্বই দশকের শুরু, এই পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে শিল্পগুলির আপাত রোশনাইয়ের নীচে প্রচ্ছন্ন নাভিশ্বাসগুলো সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সামনে চলে এল। যে কারখানাগুলো বন্ধ হল না, সেগুলোর মালিকানা বদল হল। এবং বদলের পরেই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই। কন্ট্রাক্ট লেবার কথাটা তখন প্রথম শুনলাম। সংসারে তখনও প্রয়োজন ছিল, যতীনকাকার ছোট ছেলে তখনও ক্লাস ফোর। যতীনকাকা খুব অনিচ্ছার সঙ্গে টিটাগড়ে নিজের বন্ধ কারখানার সামনের ফুটপাতে গামছার দোকান খুলে বসলেন। অবশ্য বেশিদিন করতে হয়নি সেই অনিচ্ছার কাজ। ব্রেইনস্ট্রোক।
আমরা বড় হতে থাকলাম আর আমাদের চোখের সামনে আশেপাশে আমাদেরই আগের প্রজন্ম ব্যর্থতায় হতাশায় কুঁকড়ে ছোট হয়ে যেতে লাগল। তারপর কিছুদিন চায়ের দোকানে বেঞ্চের প্রান্তে, বৈকালিক তাসের আড্ডায়, রেশনের লাইনে ব্যাগ হাতে প্রেতের মতো দেখা যেত এইসব ক্ষয়াটে মানুষদের। এরপর কবে যেন তাঁরা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আজও মাঝে মাঝে সেইসব রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরি, টিমটিমে আলো আধো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে কিছু কারখানা, আর কারখানার মৃতদেহের ওপর গড়ে তোলা কিছু আধুনিক টাউনশিপ। বঙ্গশ্রী, হিন্দ মোটর, রোহিনী মিলের জায়গায় আজ গোডরেজ, গ্র্যান্ড সিটি, জেনেসিস। লাইফস্টাইল লিভিং, জিম, সুইমিং পুল, সেভেনটি পারসেন্ট গ্রিনারি। অন্য রূপকথা। কালের নিয়মে বদলে গেছে আমাদের মফস্বল। এখন আর সকালে উঠে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে না কেউ। পাশের বাড়ি থেকে রেওয়াজ করার শব্দ আসে না আর। বরং টিভি খুললেই ভেসে আসে ফ্ল্যাট বেচার জন্য 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা'-র অক্ষম প্যারডি। এর চেয়ে সময়োপযোগী, এর চেয়ে পরিহাসময় বাস্তব আর কীই বা হতে পারে এই মুহূর্তে?
তবু রুটিটা গড়িয়েই চলেছে। অনেক মানুষ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে সেটা। পারছে না। দুনিয়া জুড়ে বেড়ে চলেছে শাসক আর শাসিতের ব্যবধান। ক্ষোভ জমছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। যাঁরা নিজেরাই রুটি বানান, রুটির নাগাল পাচ্ছেন না তাঁরাও। আমাদের দেশে হাজারো কৃষক পায়ে হেঁটে জমা হচ্ছেন নাসিকে, মুম্বাইয়ে, দিল্লিতে।
রূপকথা বোধহয় পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না কোনওদিন।
No comments:
Post a Comment